মিশরীয় খ্রিস্টানদের দু’টি গির্জায় সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ৪২ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস এই ঘৃণ্য হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে জানা যায়। এমন সময় এই নাশকতার ঘটনা সংঘটিত হল যখন মার্কিন বিমান হামলার মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নিতে চলেছে। রাশিয়া ও সিরিয়ার যৌথ সামরিক পদক্ষেপে বিদ্রোহী ও আইএস যখন সিরিয়া ও ইরাকে কোণঠাসা হয়ে পশ্চাৎপসারণ করছে তখন মিশরের কপটিক চার্চে আইএস’র নামে হামলা চালিয়ে যুদ্ধকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতিকে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এ ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা বাড়িয়ে দিয়েছে সেই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার একটি অপচেষ্টা হিসেবে ধরে নেয়া যায়। মিশরের কপটিক খ্রিস্টানরা সে দেশের অন্যতম প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। মিশরের জনসংখ্যার প্রায় ১৫ ভাগ কপটিক খ্রিস্টান। মিশরীয় খ্রিস্টানদের ইস্টার উৎসব এবং ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের পোপ ফ্রান্সিসের মিশর সফরের প্রাক্কালে চার্চে এই রক্তাক্ত হামলার ঘটনা মিশরের ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সহাবস্থানের পরিবেশকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়ার অপপ্রয়াস হিসেবে গণ্য করা যায়।
তানহা প্রদেশের একটি গির্জায় সন্ত্রাসী বোমা হামলায় ২৯ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কপটিক চার্চের পীঠস্থান আলেকজান্দ্রিয়ায় কপটিক চার্চের পোপ তাওয়াদ্রোস একটি প্রার্থনা সভায় অংশগ্রহণের প্রাক্কালে দ্বিতীয় বোমা হামলার ঘটনাটি সংঘটিত হয়। আগে পুঁতে রাখা বোমার বিস্ফোরণ নাকি আত্মঘাতী বোমা হামলা- এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া না গেলেও এই ঘটনাবলীর পেছনে সুদূর প্রসারী চক্রান্তের যোগসাজশ থাকতে পারে। গত বছরের ডিসেম্বরেও কায়রোর একটি কপটিক চার্চে বোমা হামলায় অন্তত ২৫ জন নিহত হয়েছিল। ছয় বছর আগে গণআন্দোলনের মুখে সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর মিশরের ইতিহাসের প্রথম অবাধ জাতীয় নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিজয়ের মধ্য দিয়ে সে দেশে যে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা সূচিত হয়েছিল, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপর মধ্য দিয়ে সে রাজনৈতিক ধারা নস্যাৎ হয়ে যাওয়া এবং সেনানিয়ন্ত্রিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সাবেক সেনা প্রধানের ক্ষমতা গ্র্রহণের মধ্য দিয়ে মিশরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রলম্বিত আকার ধারণ করে। মিশরীয় জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে একধরনের রাজনৈতিক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ রয়েছে। সেই বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে আইএস’র নামে এসব সাম্প্রদায়িক নাশকতার ঘটনা ঘটিয়ে মিশরের শত্রæরা হয়তো সেখানে আবারো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরী করতে চাচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী ঘটনার সাথে ইসলাম ও মুসলমানদের কোন সম্পর্ক নেই। তথাপি পশ্চিমা মিডিয়াগুলো তথাকথিত আইএস’র সাথে ইসলাম ও মুসলমানদের সমার্থকভাবে প্রচারণা চালিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে ভীতি ও বিরূপ ধারণা তৈরী করছে।
গত বছর ফ্রান্সের একটি চার্চে আইএস’র নামে সন্ত্রাসী হামলার পর ক্যাথলিক পোপ ফ্রান্সিস এসব সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামসহ কোন ধর্মের সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেছিলেন। আইএস সহ বিশ্বব্যাপী চলমান সন্ত্রাসী ও আত্মঘাতী হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে যেমন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা দায়ী। পক্ষান্তরে সাম্রাজ্যবাদের চাপিয়ে দেয়া অর্থনৈতিক লুণ্ঠনব্যবস্থা, সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার প্রধান শিকার মূলত মুসলমানরা। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী সামরিক আগ্রাসন এবং মানবাধিকার হরণের ধারাবাহিক ঘটনাগুলোর কারণে সংক্ষুব্ধ মানুষগুলোকে আল কায়েদা ও আইএস’র মত জঙ্গি গ্রুপে ভেড়াতে পরোক্ষভাবে প্রলুব্ধ করার পাশাপাশি নানাভাবে তাদেরকে সহযোগিতার অভিযোগ ইসরাইল ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধেই। এ কথা স্পষ্ট যে এসব জঙ্গিবাদী ও আত্মঘাতী হামলার প্রধান ভুক্তভোগী যেমন মুসলমান দেশগুলো, আবার জঙ্গিবাদ দমনের দোহাই দিয়ে পশ্চিমা সামরিক হামলার টার্গেটও হচ্ছে মুসলমান দেশগুলোই। অন্যদিকে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের তকমা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর মুসলমান নাগরিকদেরকে যেমন অযথা হয়রানির শিকারে পরিণত করা হচ্ছে, সেই সাথে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ ভিসা নিয়ন্ত্রণ করাসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অর্থাৎ সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদকে ঘিরে যে সব সাম্রাজ্যবাদী সামরিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তার পরোক্ষ টার্গেট যেন সমগ্র মুসলমান সম্প্রদায়। সেই প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে ইরাক ও আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব শুরু করেছিল তার ফল এখনো সারাবিশ্বই ভোগ করছে। এতদিনে এ বিষয়টিও পরিষ্কার হয়েছে যে, শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দিয়ে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়। যে সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কারণে এসব সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর আকার ধারণ করেছে, তা’ দূর করার আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যা সমাধানের কোন বিকল্প নেই। কোন মসজিদ, মন্দির বা চার্চে হামলার ঘটনার সাথে ইসলাম, মুসলমান বা অন্যকোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সম্পর্ক থাকতে পারে না। কপটিক চার্চে বোমা হামলার ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সংশ্লিষ্ট সকলকে সম্ভাব্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন