গ্রীষ্মকালীন ফলের মধ্যে বেল একটি উল্লেখযোগ্য ফল। এটি ছোট-বড় সকলের নিকট অতি পরিচিত এবং অত্যন্ত পুষ্টিকর ও রোগপ্রতিরোধক। গ্রামবাংলার সর্বত্রই বেল গাছ জন্মে। তবে পাহাড়ি ও টিলা এলাকায় বেল গাছ ভালো জন্মে। বেলের আদিনিবাস ভারত উপমহাদেশে। বেল গাছে মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল আসে। পরের বছর মার্চ এপ্রিল মাসে পাকা শেষ হয়। মিষ্টি গন্ধযুক্ত হালকা সবুজে ফুল ছোট ছোট থোকায় থোকায় ধরে। ফুলের পাপড়ি তাড়াতাড়ি খসে পড়ে। ফল ধরতে ও পাকতে প্রায় ১ বছর লেগে যায়। প্রতি বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে সারা দেশে প্রচুর পরিমাণে বেল পাওয়া যায়। এ ফলটি অত্যন্ত উপকারী ও ভেষজ গুণাগুণ সম্পন্ন। পরিপাকতন্ত্রের পীড়ায় বেল খুবই উপকারী। বিশেষ করে আমাশয় নিবারণে, অ¤øনাশে, রক্ত আমাশয়ে, পেটের গোলযোগ উপশমে, গায়ের দুর্গন্ধ দূরীকরণে, মদির প্রবণতা রোধে, শুক্রতারল্য স্বাভাবিক করণে বেল একটি শ্রেষ্ঠ ঔষধি ফল। বেল কাঁচা ও পাকা অবস্থায় খাওয়া যায়। হেকিমি মতে, বেল পাকার চেয়ে কাঁচা অবস্থায় বেশি উপকারী। আসলে গাছ থেকে কাঁচা বেল সংগ্রহ করে ঘরে রেখে আগুনে তাপ দিয়ে খেলেই ভালো উপকার পাওয়া যায়। তবে মনে রাখবেন গাছের টকটকে পাকা বেল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হলেও তার বিপরীতে কিছু ক্ষতি করতে পারে। পাকা অবস্থায় বেল খেলে অন্ত্র বা মল ভাÐারের দোষকে সংশোধন না করে মল জোরপূর্বক বের করে আনে। কিন্তু কাঁচা বেল পাচক ও অগ্নিবল বাড়িয়ে দিয়ে আমদোষ পরিপাকান্তে মল সহজ সরল করে বের করে আনে। কাজেই কাঁচা বেলই স্বাস্থ্যের জন্য মঙ্গলজনক। বেলের বৈজ্ঞানিক নাম অবমষব গধৎসবষড়ং। উদ্ভিদ জগতের জঁঃধপবধব পরিবারের উদ্ভিদ। ইংরেজি ডড়ড়ফ অঢ়ঢ়ষব, আরবি ভাষায় সফরজল, সংস্কৃতিতে বিল্ব, হিন্দি ও বাংলায় বেল। ফল গোলাকার, ধূসর অথবা হলুদাভ শক্ত খোলসযুক্ত। ফলের শাঁসের ভিতর ৮-১৫টি কোষ বা খÐ থাকে। প্রতি খÐে শাঁসের সাথে চটচটে আঠার মতো অনেক বীজ থাকে। বীজ ফেলে দিয়ে শাঁস খাওয়া হয়। বেলের প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে পুষ্টি উপাদান হলো খাদ্যশক্তি ১৪০ কিলোক্যালরি, পানি ৭৭.৫ গ্রাম, আমিষ ২.৬০ গ্রাম, শর্করা ৩১.৮ গ্রাম, ¯েœহ ০.৩৯ গ্রাম, ভিটামিন-এ ৫৫ মিলিগ্রাম, খনিজ পদার্থ ১.৭ গ্রাম, আঁশ ২.৯ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, থায়ামিন (ভিটামিন-বি-১) ০.১৩ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন (ভিটামিন বি-২) ১.১৯ মিলিগ্রাম, এসকরবিক এসিড বা ভিটামিন সি-৬০ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন (ভিটামিন বি-৬) ১.১ মিলিগ্রাম টারটারিক এসিড ২.১১ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৮ মিলিগ্রাম, লৌহ ১.১ মিলিগ্রাম।
রাসায়নিক উপাদান : ফলের শাঁসে থাকে ডি-আলফা ফেলান ড্রিন সম্বলিত এক প্রকার উদ্বায়ী তেল, অ্যালকোহল, ইস্টার টার্পিন, মারমেসিন, ট্যানিন, মিথাইলহাল ফোরডিনল, আইসো পেন্টাইলিহাল ফোরডিনল, বিটা-সিটোস্টেরল, পাতায় থাকে মারমেলোসিন, ইয়াজোলিন, ইয়জেলিনিন, কমারিন, পরিফেনলিক যৌগ, লু পেয়ল, সিটোস্টেরল ইত্যাদি।
বেলে প্রচুর পমিাণ ভিটামিন সি থাকে। যা স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করে এটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা আমাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সর্দি কাশি ও ছোঁয়াছে রোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখে। ভিটামিন এ আমাদের চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে, রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগ সারিয়ে তোলে। অন্ত্রের কৃমিসহ নানা রোগজীবাণু ধ্বংস করে। নিয়মিত বেল খেলে এর ল্যাকোটিভগুন কোষ্টকাঠিন্য দূর হয় ও মুখের ব্রণ দূর হয় এবং ত্বক ভালো থাকে। বেল পাকস্থলির আলসারসহ নানা সমস্যা দূর করে। বেলের উপাদান মিউকাস মেমব্রেনের গঠনে সহায়তা করে এবং চামড়ার সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে তোলে। বেলের ভিটামিন বি১ ও বি২ হৃৎপিÐের এবং লিভার ভালো রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত বেল খেলে স্তন ক্যান্সার, ইউটেরাম ও কোলন ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে দেয়। বেল প্রজেস্টেরণ হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে নারীদের বন্ধ্যত্বের হার দূর করে। বেলের পুষ্টি উপাদান চোখের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অঞ্চলসমূহের পুষ্টি জোগায়। ফলে চোখ যাবতীয় রোগ থেকে রক্ষা করে। বেলের শাঁস ত্বককে সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে এবং ত্বকের স্বাভাবিক রং বজায় রাখে।
ঔষধি গুণাগুণ
* যাদের গায়ে ঘাম বেশি হয় এবং ঘামে খুব দুর্গন্ধ হয় তারা বেল পাতার রস পানিতে মিশিয়ে সেই পানি দিয়ে শরীর মুছে নেবেন। কিছুক্ষণ পর গোসল করে নেবেন। এতে গন্ধ থাকবে না।
* কচি বেল কেটে টুকরো টুকরো করে নিয়ে তা পানিতে ভিজিয়ে সারা রাত রেখে দিন। পরদিন সকালে ছেঁকে নিয়ে পানি পান করুন। এতে আমাশয় ও ডায়রিয়া ভালো হবে।
* যাদের পেটে গ্যাস হয় বা পায়খানা পরিষ্কার হয় না। তারা নিয়মিত বেলের শাঁস খান। সমস্যা কমে আসবে। * অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে মনে রাখতে পারে না। তাদের জন্য ২-৫টি বেল পাতা গাওয়া ঘিতে ভালো করে ভেজিয়ে মুড়মুড় করে অল্প মিসরির গুঁড়ো মিশিয়ে প্রতিদিন একবার করে খেতে দিন। কিছু দিন খাওয়ালে স্মৃতিশক্তি বাড়বে এবং মেধাশক্তিও বেড়ে ওঠবে।
* যারা পাকস্থলির আলসারে ভুগছেন তারা কচি বেলের টুকরো বা বেলশুট পরিমাণ মতো বার্লির সাথে একত্রে পাক করে পরে ছেকে নিয়ে বার্লিগুলো খেয়ে নিলে অল্প দিনেই আলসারের সমস্যা কমে আসবে।
* যেসব পুরুষের শুক্র বেশি পাতলা বা প্রসাবের রাস্তায় পিচ্ছিল আকারে ঝরে তারা বেলগাছের ছালের টাটকা রস ২০ মিলিমিটার গরুর দুধ ১৫০ মিলিমিটার, জিরার গুঁড়া ১ গ্রাম এ তিনটি এক সাথে মিশিয়ে নিয়ে দিনে একবার করে খেলে সমস্যা কমে যাবে।
* যাদের হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও পাকস্থলি দুর্বল তারা ৩০-৩৫ গ্রাম পাকা বেলের শাঁস শরবত করে সকাল বিকাল দুবার খান বেশি উপকার পাবেন।
* বেল পাতার সাথে ৩/৪টি গোল মরিচ পিষে ফোঁড়ার ওপর লাগিয়ে দিলে ফোঁড়া বসে যায়।
* বেল গাছের মূলের ছালের রস খেলে রক্তের সুগার বা চিনি কমে যায় এবং হৃৎপিÐের ও পেটের ব্যথা সরে যায়।
* কাঁচা বেল শাঁস চাকা চাকা করে কেটে নিয়ে রৌদে শুকিয়ে বেল শুট তৈরি করা হয়। পেটের যে কোনো সমস্যায় ব্যথা, আমাশয়, পেট ফাপা, ডায়রিয়া, গ্যাস্ট্রিকের জন্য এই বেলশুট সিদ্ধ করে পানিসহ পান করুন। সমস্যা কমে আসবে।
* বেলগাছের ফুল মসুর ডাল ধোয়া পানির সাথে ভালো করে পেষণ করে মিশ্রণটি মুখমÐল হাতে ব্যবহার করুন। অল্প দিনের মধ্যে চেহারা নমনীয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠবে।
সতর্কতা
থাইরয়েড রোগী এবং গর্ভবতী মহিলাদের বেল না খাওয়াই ভালো। কাঁচা বেল পাতার রস বেশি পরিমাণ খাওয়া নিষেধ। এতে যৌন শক্তি কমে যায়। তাই পাতার রস খাওয়ার ব্যাপারে সর্তক থাকুন।
এ উপকারী গাছটি বাড়ির আশেপাশে বা পতিত জমিতে লাগান এবং যতœ নিন।
মো. জহিরুল আলম শাহীন
শিক্ষক, কলাম ও স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক
ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
গোলাপগঞ্জ, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন