সোলায়মান। মোহাম্মদ আলীর ১৭ বছর বয়সী ছেলে। উচ্চতা ১২৮ সেন্টিমিটার। নিম্ন শিক্ষিত, নিম্নমধ্যবিত্ত মোহাম্মদ আলী আর্থিক অসঙ্গতির কারণে ছেলেকে সঠিক চিকিৎসকের পরামর্শ দিতে পারেননি। এখন মোহাম্মদ আলীর বোধদয় হয়েছে; সে চিকিৎসকের দারস্থ হচ্ছে অবেলায়।
সোলায়মান ও সমাজের অন্য অনেক খাটো ছেলের মতো ঠাট্টা-তামাশার পাত্র হয়েছে। আমাদের সমাজে খাটো মানুষকে নিয়ে অনেক ঠাট্টা-তামাশা করা হয়, ব্যবহার করা হয় চলচ্চিত্র, নাটক, সার্কাসে। জীবনের বহু ক্ষেত্রেই বামনদেরকে ভাঁড় বা হাস্যরসের খোরাক হিসাবে নেওয়া হয়। বামনত্ব কখনই ঠাট্টার বিষয় নয়। এটি একটি শারীরিক-হরমোনজনিত সমস্যা (প্রধানত, যার স্বাস্থ্যসম্মত চিকিৎসা করা সম্ভব। আর সময় মতো বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা করতে পারলে ফলাফল দারুণ আশাব্যাঞ্জক; বিশ্বখ্যাত ফুটবলার লিওনেল মেসি এর জলজ্যান্ত উদাহরণ)। আর এই সফল চিকিৎসার কারণেই বিশ্ব আজ তার মতো খেলোয়ারকে পেয়েছে। কিন্তু শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া বা সঠিক দৈহিক বৃদ্ধি না হওয়ার কারণ, সমস্যা নির্ণয় ও এর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই এখনও রয়েছে অন্ধকারে অথবা মারাত্মকভাবে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে অপচিকিৎসার আশ্রয় নিচ্ছে। যদিও এই সব সমস্যা শনাক্তকরণ বা নিরূপণ, চিকিৎসা প্রদান ও দেখাশোনা করা আমাদের পক্ষে খুব সহজেই সম্ভব।
ভাবনার শুরু হতে পারে কখন?
একটি শিশু যদি তার সমবয়সীদের তুলনায় কম উচ্চতা সম্পন্ন হয় তবেই অভিভাবকরা এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে থাকেন। তবে তার নিজের ভাই-বোনের সাথে ঐ একই বয়সের উচ্চতার তারতম্যটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যার বাবা-মা দুই জনই অধিক উচ্চতার, সে লম্বা হওয়ার বেশি দাবিদার। বাপ-মা খাটো হলে সন্তানও খাটো হবে সঙ্গতভাবেই ধরে নেওয়া যায় তা। আবার ছেলে সন্তান সাধারণত বড় ভাই বা পিতার দৈহিক বৃদ্ধির ধারা অনুসরণ করতে পারে। কন্যা সন্তান মা-বা বড় বোনের দৈহিক বৃদ্ধির সাথে তাল মেলাতে পারে। জেনে রাখুন একেক বয়সে উচ্চতা বৃদ্ধির হার একক রকম; ২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু বছরে ২০ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এরপর এই হার কমে আসে এবং ৫/৬ বছর বয়স পর্যন্ত এই হার বছরে ১০-১২ সেন্টিমিটার। ৬/৭ বছরে আরও কমে বছরে ৫/৬ সেন্টিমিটার হারে বাড়ে। আবার বয়ঃসন্ধিকালে হঠাৎ করে লম্বা হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং বছরে ১০/১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে থাকে। ১৪/১৫ বছরের পর থেকে বৃদ্ধির হার আবারও কমতে থাকে, গড়ে ১ সেন্টিমিটার হারে বেড়ে চলে ১৯ থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত। উল্লেখ্য যে, এরপর বৃদ্ধি থেমে যায়।
দৈহিক বৃদ্ধি না হওয়া বা বামনত্বের কারণ
একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি অনেকটাই যেমন জিনগত ও পরিবেশগত বিষয়ের উপর নির্ভর করে, তেমনি নির্ভর করে তার সার্বিক সুস্থতা ও হরমোনের ওঠানামার উপর। একেক এলাকায় ও একেক পরিবারে উচ্চতা প্রবণতা একেক রকম। এছাড়া শৈশবে কোন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা যেমন কিডনি বা ফুসফুসের রোগ, অপুষ্টি, হজমের গোলমাল ইত্যাদি কারণে শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শরীরে প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি যে হরমনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে তার মধ্যে থায়রয়েড ও গ্রোথ হরমোন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ হরমোনগুলোর অভাবে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি থমকে যেতে পারে বা ধীরে হতে পারে। নানা ধরনের জেনেটিক সম্যায় মানুষ খাটো হয় যেমন টার্নার বা ডাউনস সিনড্রোমে।
দৈহিক বৃদ্ধি প্রতিবন্ধকতা শারীরিক বা মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে কি?
ঠিকমত বৃদ্ধি না হলে একটি শিশু নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা আক্রান্ত হয়। অনেক সময় এ বৃদ্ধি প্রতিবন্ধকতা সঙ্গে যৌবন প্রাপ্ত না হওয়ার সমস্যা দেখা দেয়, যা পরবর্তীতে তার বিবাহ, সন্তান ধারণ বা পারিবারিক জীবনকে ব্যাহত করবে। এছাড়া এ শিশুরা ট্রিজিং ও বুলিংয়ের শিকার হয় বেশি, সমাজে এক ঘরে হয়ে পড়ে, শিক্ষা বা কর্ম ক্ষেত্রে অনেক মেধা থাকা সত্তে¡ও পিছিয়ে পড়ে আমাদের দেশে নানা কুসংস্কারের শিকার হয় এরা।
বৃদ্ধি প্রতিবন্ধকতা বা বামনত্বের চিকিৎসা
কৃত্তিম গ্রোথ হরমোন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে খর্বাকৃতি শিশুদের চিকিৎসা দুরূহ ছিল, কারণ তখন মৃত দেহের পিটুইটারি গ্রন্থির হরমোন নির্যাস সংগ্রহ করা হতো এবং এতে প্রায়ই প্রতিক্রিয়া ও নানা রোগের আশঙ্কা থাকতো। ১৯৮৫ সালে এ পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়। বর্তমানে কৃত্তিম গ্রোথ হরমোন সোমাটোট্রোপিন বা নরডিট্রোপিন দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে এর চিকিৎসা করা হচ্ছে। যে কয়েকটি সমস্যা গ্রোথ হরমোন থেরাপি ব্যাহত হয় তা হলো : ১ বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত শিশু যার গ্রোথ হরমোন অপর্যাপ্ত, ২. টার্নার সিনড্রোম ৩. কম ওজন ও ছোট আকার নিয়ে ভ‚মিষ্ঠ শিশু এবং ৪. কিডনি জটিলতা আক্রান্ত কারণে যাদের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। হরমোন বিশেষজ্ঞের (এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট) পরামর্শ অনুযায়ী এটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন রাতে নির্দিষ্ট মাত্রার গ্রোথ হরমোন ইনজেকশন দেওয়া হয় এবং পর্যবেক্ষণ করা হয়। গ্রোথ হরমোনের সমস্যা ছাড়া বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার অন্য কারণ থাকলে সঠিক কারণটি নির্ণয় করে সে অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। তবে দুটো বিষয় মনে রাখবেনÑ এক. সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও পরামর্শ নিতে হবে, এবং দুই. যত কম বয়সে চিকিৎসা শুরু করা যায় ততই ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। কৈশোর বা তারুণ্যে এসে উচ্চতা বৃদ্ধি কি সম্ভব? উচ্চতা সমস্যা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি আমাদের দেশে কৈশরে বা তারুণ্যে এসে। যখন একটি তরুণ বা তরুণী দেখে যে সে অন্য দশ জনের মতো নয়। এ সময়ে উচ্চতা বাড়ানোর কৌশল হিসেবে নানা বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয় এবং নানা ধরনের অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার আশ্রয় নেয়। দৈহিক উচ্চতা ততদিনই বাড়ে যতদিন পর্যন্ত আমাদের কাঠামো বা কঙ্কাল বৃদ্ধি পেতে থাকে। হাড়ের শেষ মাথায় অবস্থিত তরুণাস্থি বা প্লেটটি হাড়ের সঙ্গে মিশে না যায়। যৌবন প্রাপ্ত হলে হরমোন এর প্রভাবে এ প্লেট মূল হাড়ের সঙ্গে মিশে যায়। বা ফিউশন হয়ে যায়, এরপর আর হাড় লম্বায় বাড়তে পারে না। সাধারণত এ ফিউশন ছেলেদের ১৬ বছর ও মেয়েদের ১৪ বছরের মধ্যে ঘটে। যদিও ১৯ থেকে ২১ বছর পর্যন্ত আরোও কিছুটা উচ্চতা বৃদ্ধি হতে পারে তবুও ফিউশন হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসা করলে তেমন কোন ফল পাওয়া যাবে না।
ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট (হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল নং- ০১৮২৬ ২০০৬৬৫
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন