দেশের অন্যতম চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু ওয়ার্ডের ছাদে বসানো হয়েছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন দুটি মোবাইল টাওয়ার। দৈনিক ইনকিলাবের খবরে বলা হয়েছে, এসব টাওয়ার থেকে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা বিকিরিত হয়, যা নবজাতক ও শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সরেজমিন রিপোর্টে বলা হয়েছে, টাওয়ার দুটো হাসপাতালের বাইরে থেকে দৃষ্টিগোচর হয় না। এভাবে টাওয়ার স্থাপনের কারণ সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়েছে, আলোচ্য হাসপাতালে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা হাসপাতাল প্রশাসনকে ছাপিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই সিন্ডিকেটই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে মোবাইল ফোন কোম্পানিকে টাওয়ার বসানোর অনুমতি দিয়েছে। টাওয়ার পর্যবেক্ষণ ও সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে ছাদে যেসব ভারী যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে, তাতে যে কোনো সময়ে ছাদের অংশ ভেঙে পড়তে পারে। পুরনো ছাদের প্লাস্টার ধসে পড়ার ছবিও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ থেকেও রোগীরা ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হতে পারে। রেডিওলজিস্ট ও ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. মোশাররফ হোসেন ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, যে কোনো ধরনের রেডিয়েশনই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এটি দৃশ্যমান নয়। আজকে যে রেডিয়েশনের শিকার হচ্ছে, আগামী ১০ বছর পরে হয়তো এর প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। তিনি বলেছেন, এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে উন্নত বিশ্বে আবাসিক এলাকা থেকে যথাসম্ভব দূরে টাওয়ার স্থাপন করা হয়। তিনি নিশ্চিত করেছেন, এ ধরনের টাওয়ার নবজাতক ও প্রসূতির জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর।
শিশুর প্রতি অবহেলা কার্যত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নির্দেশক। বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতার বাইরেও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে শিশুস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কৃত্রিম শিশুখাদ্যের উৎপাদন ও বিপণন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের বৈশ্বিক পুষ্টি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২২ শতাংশ নবজাতক কম ওজন নিয়ে জন্মায়। দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি পাঁচ শিশুর দুটি খর্বাকৃতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট যক্ষ্মা রোগীর প্রায় ১০ শতাংশ শিশু। এক আলোচনায় বলা হয়েছে, দেশে শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্তের হার ৩.৩৭ ভাগ। আলোচনায় শিশু যক্ষ্মা শনাক্তকরণের নানা সমস্যার কথাও বলা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এ কথা বলা যায়, দেশের উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও দেশের অধিকাংশ শিশুর অবস্থা কোনো দিক থেকেই ভালো নেই। একদিকে তারা যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তেমনি খাদ্যাভাবজনিত অপুষ্টি তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে। অন্যদিকে নাম-পরিচয়হীন শিশুরা সামাজিক নৈরাজ্যের শিকারে পরিণত হচ্ছে প্রতিদিন। দেশের সরকারি হাসপাতালের শিশু বিভাগের ওপর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর মোবাইল টাওয়ার কীভাবে বসানো হলো তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
মোবাইল টাওয়ারের নানামাত্রিক ক্ষতিকারক দিক নিয়ে এর আগেও রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আলোচিত ক্ষতির মধ্যে একটি বড় হুমকি হচ্ছে বজ্রপাতজনিত ঝুঁকি। বজ্রপাতের সময় মোবাইল টাওয়ারের কারণে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। অলোচ্য ক্ষেত্রে হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কীভাবে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ টাওয়ার বসানোর অনুমতি দিয়েছেন, তা-ই এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমতির তোয়াক্কা না করে এ ধরনের টাওয়ার বানানোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। মোবাইল টাওয়ার স্থাপনের সাথে অর্থের লেনদেনে বিষয়টি নতুন কিছু নয়। সংশ্লিষ্ট দুটি অপারেটর গ্রামীণফোন ও বাংলা লিঙ্কও এ ব্যাপারে এক ধরনের গোপনীয়তা রক্ষা করছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যেমন মোবাইল ফোনের টাওয়ার স্থাপনকে অস্বীকার করার যাবে না, তেমনি এর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিকে মেনে নেয়ার পক্ষেও কোনো যুক্তি নেই। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলো যে পদ্ধতি ও নিয়মনীতি অনুসরণ করে, আমাদেরও তা করা উচিত। বিদ্যমান বাস্তবতায় শিশু ও প্রসূতিদের নিরাপত্তার বিবেচনায় অবিলম্বে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ওপর থেকে মোবাইল টাওয়ার দুটির অপসারণ জরুরি। সেইসাথে হাসপাতালসহ এ ধরনের স্পর্শকাতর স্থাপনায় যাতে মোবাইল টাওয়ার স্থাপিত হতে না পারে সেজন্যও সতর্ক হতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত কে বা কারা কীভাবে মোবাইল টাওয়ার বসানোর মতো ধৃষ্টতা দেখাতে পারল, সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে এবং অপরাধীদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। দেশে শিশুস্বাস্থ্য রক্ষার সাথে কোনো অবস্থাতেই আপস করা যাবে না। সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে সতর্ক ও যতœবান হবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন