শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

যমুনার ভাঙন ও পাউবোর দুর্নীতি ঠেকাতে হবে

প্রকাশের সময় : ৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) মাধ্যমে সরকার একদিকে প্রতিমাসে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করছে, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে লক্ষকোটি টাকা মূল্যের ভূমি ও জনপদ নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে যমুনার ভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি ও জনবসতি বিলীন হলেও তা রোধে সরকারের উদ্যোগ খুব সামান্য ও অপ্রতুল। দেশের মূল্যবান ভূমি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ ও প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ না করে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট এবং তার যথাযথ বাস্তবায়নে ব্যর্থতা জাতির অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিশেষত যমুনা বিধৌত জামালপুর, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার শত শত গ্রাম ইতিমধ্যেই ভাঙনের কারণে বিলীন হয়ে গেছে। এ বিষয়ে পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। গত কয়েক বছরে যমুনার ভাঙনে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার সাপধরি নামের একটি ইউনিয়ন মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এর আশপাশের আরো কয়েকটি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামও নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে। একইভাবে সমুদ্রোপকূলবর্তী জেলা কক্সবাজার, পটুয়াখালী, ভোলাসহ সন্দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, মহেশখালির বিস্তীর্ণ এলাকার হাজার হাজার হেক্টর ভূমি প্রতিবছর সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এসব জনপদের ভাগ্যবিড়ম্বিত, মানুষ নিজেদের জমি-জিরাত রক্ষায় প্রয়োজনীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবীতে প্রশাসনের কাছে আবেদন-নিবেদন, মানববন্ধনসহ নানা রকম কর্মসূচি পালন করেও তেমন কোন সুফল পায়নি।
গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি সরেজমিন রিপোর্টে জানা গেছে, যমুনা নদীর ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চলমান প্রকল্পের কাজ আগামী এপ্রিলের মধ্যে শেষ করতে না পারলে চৌহালী উপজেলার আরো ২ কিলোমিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। গত কয়েক বছরের ভাঙনে চৌহালী উপজেলার অন্তত ৫০ হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। একদিকে নদীর গ্রাসে চলে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম, অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন প্রতিরোধে প্রকল্প গ্রহণ করে তা সম্বুক গতিতে বাস্তবায়নের লোক দেখানো নাটক করে যাচ্ছে। ইনকিলাব প্রতিনিধির কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় চৌহালীর ভুক্তভোগী মানুষের কণ্ঠে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকা-ের প্রতি তাদের অনাস্থা প্রকাশ পেয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলমান নদী-ভাঙন এবং ভাঙন প্রতিরোধে অপ্রতুল বাজেট নিয়ে দুর্নীতি, লুটপাটের চিত্র দেখছে ভুক্তভোগীরা। চৌহালীর একজন কৃষক সাংবাদিকের কাছে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘বাজান হেরা কি কাম করে বুঝি না, যমুনার ভাঙন তো ঠ্যাহে না, মাইনসে কয় নদীতে কয়ডা পাথর-বস্তা ফেলি সব ট্যাহা নিয়া গেছে’। নদীভাঙন প্রতিরোধ, বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় সকল প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই একই চিত্র বিদ্যমান। এভাবে নদীভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে কোটি মানুষের জনপদ রক্ষা করা সম্ভব নয়।
জনগণের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে একের পর এক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। কানেক্টিভিটি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রশ্নে এসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। তবে যে সব মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গতিসঞ্চারের জন্য শত শত কোটি ডলার ব্যয়ে যুমনা সেতু, পদ্মাসেতুর মত মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সে সব নদীর ভাঙন থেকে কোটি মানুষকে রক্ষা করতে এর শতভাগের একভাগ বাজেটও বরাদ্দ রাখা হচ্ছে না। দু’বছর আগে পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, যুমনার ভাঙন ঠেকাতে জামালপুর বাউবো নির্বাহী প্রকৌশলীর পক্ষ থেকে ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হলে সরকার বরাদ্দ দিয়েছিল ৪০ কোটি টাকা। বিভিন্ন নদ-নদীর ভাঙনে বছরে ৬ হাজার হেক্টরের বেশী কৃষিজমি হারাচ্ছে দেশ। যদিও শুধুমাত্র অর্থের মানদ-ে নদীভাঙন বা পরিবেশ দূষণের ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ন করা যায় না তথাপি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নদীভাঙনের কারণে দেশের অর্থনীতিতে গড়ে বছরে ক্ষতির পরিমাণ জাতীয় বাজেটের প্রাক্কলিত রাজস্বের শতকরা ২ ভাগের বেশী। নদীকে নাব্য রাখতে, ভাঙন ঠেকাতে এবং সুপরিকল্পিত, দীর্ঘস্থায়ী নদী শাসনের পেছনে রাজস্ব খাতের অন্তত একভাগ বরাদ্দ রাখার পাশাপাশি বাজেট বাস্তবায়নের টাইমলাইন এবং কাজের মান রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চৌহালীর হাজার হাজার পরিবার জমি ও বসতভিটা হারানোর পর পানি উন্নয়ন বোর্ড যুমনার ভাঙন ঠেকাতে যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, আগামী বর্ষার আগেই তার যথাযথ পরিসমাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বর্ষায় নতুন ভাঙনে প্রকল্পের ইতিমধ্যে সমাপ্ত কাজ যেন ভেস্তে না যায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের সচেতন উদ্যোগ থাকতে হবে। এইসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শত শত কোটি টাকা পানিতে ফেলা বা লুটপাট, ভাগাভাগির দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন