কোরিয়া উপদ্বীপে বিমানবাহী মার্কিন রণতরী মোতায়েনের মার্কিন ঘোষণা এবং উত্তর কোরিয়ার ষষ্ঠ পারমাণবিক পরীক্ষার প্রস্তুতির প্রেক্ষিতে যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে পারে বলে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইটে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিলে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এরপর মার্কিন বিমানবাহী রণতরী মোতায়েনের ঘোষণা এবং কোরিয়া উপদ্বীপ অভিমুখে ভিনসন স্ট্রাইক গ্রুপের যাত্রার ঘটনায় উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে। উত্তর কোরিয়াকে ষষ্ঠ পারমাণবিক পরীক্ষা থেকে নিরস্ত করা না গেলে সে যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করে ফেলতে পারে, এই আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছে এবং কোরিয়া উপদ্বীপে বিমানবাহী রণতরী মোতায়েনের পদক্ষেপ নিয়েছে। ওদিকে উত্তর কোরিয়ার তরফে বলা হয়েছে, মার্কিন হুমকি মোকাবিলায় দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে দ্বিধা করবে না। উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী হান সং রিয়ল বলেছেন, আমাদের শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা রয়েছে। আর মার্কিন হামলার মুখে আমরা নিশ্চিতভাবেই সে অস্ত্র হাতে নিয়ে বসে থাকব না। মার্কিন বাহিনী যেভাবে আক্রমণ করবে আমরা তার সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত। উত্তর কোরিয়া মানসম্পন্ন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে সরে আসবে না।
উত্তর কোরিয়ার এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, দেশটি মার্কিন আক্রমণের মুখে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পিছপা হবে না, সে ক্ষেত্রে আশঙ্কিত যুদ্ধ পারমাণবিক যুদ্ধে পরিণত হবে। বলা বাহুল্য, পারমাণবিক যুদ্ধের যদি সূচনা হয় তাহলে সেটা হবে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও ধ্বংসাত্মক। আর এ ধরনের যুদ্ধে দেশ দু’টিই ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে না, গোটা বিশ্বও এই ক্ষতির শিকার হবে। বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ও শঙ্কা বিস্তৃত হওয়ার এটাই মূল কারণ। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পরিণতি কি হতে পারে, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার ঘটনা থেকেই তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। জাপানের ওই দুই জায়গায় যুক্তরাষ্ট্র যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে তার ক্ষমতার চেয়ে এখনকার পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষমতা অনেক গুণ বেশি। এখন কোথাও পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার হলে তা আরো ব্যাপক এলাকা ধ্বংস করে দেবে এবং আরো অধিক সংখ্যক মানুষ স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে হতাহত ও ক্ষতির শিকার হবে। এই আশঙ্কার প্রেক্ষিতে বিশ্ব পারমাণবিক যুদ্ধের কবলে পতিত হোক তা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষই কামনা করে না। পরিণতি কী হতে পারে তা ধারণার মধ্যে থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া কেন এই বিপজ্জনক পথে এগিয়ে যাচ্ছে সেটাই প্রশ্ন। উত্তর কোরিয়ার প্রতিবেশী ও মিত্র চীন দু’দেশের এই যুদ্ধংদেহী তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং দু’দেশকেই সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। যুদ্ধের ফলে আঞ্চলিক পরিস্থিতি অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে চীন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, আমরা সব পক্ষকেই মৌখিক ও প্রায়োগিক সব ধরনের উসকানি ও হুমকি দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। তিনি সতর্ক করে দিয়ে আরো বলেছেন, যুদ্ধ শুরু হলে সব পক্ষই হারবে, কোনো পক্ষই জয়ী হবে না।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান ও বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। যে কোনো মুহূর্তে সংঘাত বা যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই চীন তার উত্তর কোরিয়া সীমান্তে বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করেছে বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিলে কিংবা উত্তর কোরিয়া ষষ্ঠ পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালালে আশঙ্কিত যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে পারে। আর এই যুদ্ধ যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবে না এমন কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্ব সভ্যতা ও মানবমন্ডলীর অস্তিত্বের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে আছে দীর্ঘদিন। পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ার একটা অঙ্গীকার পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত হলেও বিস্ময়কর বাস্তবতা হলো, পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকার অর্জনের জন্য বিভিন্ন দেশ লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর দু’টি দেশ। আজন্ম বৈরী এ দু’টি দেশের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যেতে পারে, এ আশঙ্কা সব সময়ই বিদ্যমান। কিছুদিন আগেও এমন একটা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। যাহোক, শেষ পর্যন্ত উভয় দেশই সংযম ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ এড়াতে এখন এই সংযম ও দূরদর্শিতার পরিচয়ই দিতে হবে। সন্দেহ-সংশয়, অবিশ্বাস ও অনাস্থার অবসানে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে হবে। কূটনৈতিক পথে সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতে হবে। আমরা আশা করি, উভয় দেশ মাথা ঠান্ডা রাখবে এবং সংযমশীলতার পরিচয় দেবে। ধ্বংসকর পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি থেকে বিশ্বকে কিভাবে মুক্ত রাখা যায়, বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে আজ সে কথা গভীরভাবে ভাবতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন