নগরীতে সিটিং ও গেটলক সার্ভিস বন্ধ করা হয়েছে। তবে ভাড়ার নৈরাজ্য অব্যাহত রয়েছে। যথাযথ মনিটরিং না থাকার কারণে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। একদিকে ঠাসাঠাসি করে বাসে ভর্তি করা হচ্ছে যাত্রী, অন্যদিকে ভাড়ার বৈষম্য আরো তীব্রতর হয়েছে। সেই সাথে বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কারণে অনেক পরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। যেসব বাস রাস্তায় বেরিয়েছে তাদের পোয়াবারো। নির্দিষ্ট কোনো স্টপেজ না থাকায় ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠানামা করছে। গত সোমবার থেকে রাজধানীতে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী কোনো সিটিং সার্ভিস চলাচল না করলেও ভাড়ার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভাড়া নিয়ে বিতর্ক, হৈ চৈ এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে কোথাও কোথাও মারধরের শিকার হয়েছেন যাত্রীরা। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি জানিয়েছে, বাস ও মিনিবাসে সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায়ের প্রমাণ তারা পেয়েছেন। অনেক বাসে ভাড়ার তালিকা ছিল না। এদিকে বিভিন্ন অপরাধে রাজধানীর পাঁচটি স্পটে পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে ১২২টি মামলা করেছে। জরিমানা আদায় করেছেন ২ লাখ ৯০ হাজার ৬০০ টাকা। জব্দ করা হয়েছে ৩টি গাড়ি। লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর দায়ে চারজনকে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যাত্রীকল্যাণ সমিতি একটি দৈনিককে জানিয়েছে, সিটিং সার্ভিস বন্ধ হলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। অনেক মালিক গাড়ি বন্ধ রেখেছেন। পরিবহন নেতারা বলেছেন, পরিবহনে দীর্ঘদিনের অনিয়ম এক দিনে যাবে না। এ জন্য কিছু সময় দিতে হবে।
রাজধানীতে গণপরিবহনে দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের নৈরাজ্য বিরাজমান। এই নৈরাজ্যের জন্য প্রকৃত বিবেচনায় সরকারের কোনো কোনো প্রভাবশালী মহলই দায়ী। গণপরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী মহলের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের কারণে এই খাতে শৃঙ্খলা বিধান প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে এই খাতকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের ফলে এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এক সময় বিশেষ প্রয়োজনেই রাজধানীতে সিটিং সার্ভিসের প্রবর্তন করা হয়েছিল। সে সময়ে যারা সিটিং সার্ভিসে যেতে আগ্রহী ছিলেন তারা একে স্বাগত জানিয়েছেন। এক সময় কার্যত লোকাল বা নগর সার্ভিস এবং সিটিং দুটোই চালু ছিল। আইনগতভাবে সিটিং সার্ভিসের কোনো বৈধতা কখনোই ছিল না। এখনো নেই। এরপর ভাড়ার সুবিধার বিবেচনায় সব লক্কড়ঝক্কড় মার্কা বাসই তথাকথিত সিটিং সার্ভিসে পরিণত হবার ফলে সাধারণ যাত্রীরা পড়েন মহা বিপদে। দেখা গেছে, সামান্য একটু পথ যেতেও তাদের তথাকথিত সিটিং ভাড়া গুনতে হতো। এ অবস্থা অনেক দিন থেকেই চলে আসছে। সামগ্রিক বিবেচনায় রাজধানী থেকে সিটিং সার্ভিস তুলে দেয়ার ঘোষণা আসে মালিকপক্ষ থেকেই। একে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। বাস্তবে পরিস্থিতি আরো গুরুতর হয়েছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় যেসব বাস যাতায়াত করে সেসব বাসে কোনো ভাড়ার তালিকা আছে বলে জানা যায়নি। ঐ সব এলাকার বাসগুলোতে অনেক আগে থেকেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে যেসব গাড়িতে ভাড়ার তালিকা রাখা হয়েছে সেগুলো ২০১৫ সালের। নিয়মানুযায়ী এরপর কোনো ভাড়ার তালিকা তৈরি হয়নি। সে তালিকা আর এখনকার প্রণীত তালিকায় বড় ধরনের গোঁজামিল দেয়া হয়েছে। মাইলেজের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। বিআরটিসির ভাড়ার তালিকা আর বেসরকারি বাসের ভাড়ার তালিকার মধ্যে কোনো মিল নেই। নিয়ানুযায়ী লোকাল পরিবহন হলে ভাড়ার সুবিধা পাবে যাত্রীরা। অন্যদিকে মালিকরাও বেশি ভাড়া পাবেন। এখন সকলকেই প্রায় আগের ভাড়া বা তার চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে। লোকাল পরিবহনের সাথে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়ার আদৌ কোনো সম্পর্ক না থাকলে সেটিই এখন প্রথাসিদ্ধ বলে মনে করা হচ্ছে। মূলত সিটিং সার্ভিস থেকে লোকাল সার্ভিসে প্রত্যাবর্তনের জন্য যে ধরনের পূর্বপ্রস্ত‚তি থাকা প্রয়োজন ছিল বা রয়েছে তার কোনোটি ছাড়াই এটি কার্যকর করায় পরিস্থিতি গুরুতরভাবে যাত্রীদের বিপক্ষে এবং মালিকদের পক্ষে গেছে।
পরিবহন খাতে নৈরাজ্য বন্ধের দাবি অনেক দিনের পুরনো। এ খাতে শৃঙ্খলা বিধানের যৌক্তিকতা এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। দিন দিন শহরে পরিধি বাড়ছে, বাড়ছে মানুষ। এখন পর্যন্ত গণপরিবহনই মধ্যবিত্তের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। বাস্তবতা হচ্ছে, সকালে অফিসের সময়ে এবং বিকেলে অফিসফেরত মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। অন্যদিকে রয়েছে সড়ক ব্যবস্থাপনাগত ত্রæটি। মূলত নজর দেয়া প্রয়োজন কিভাবে যাত্রীদের সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। আইনকানুন বিধিব্যবস্থা যা-ই হোক না কেন এখন পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই এটা বলা যাবে না যে, গণপরিবহন যাত্রীবান্ধব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বরং পরিবহনে যাত্রীরা একশ্রেণীর কন্ডাক্টর ও চালকদের হয়রানির শিকার হচ্ছে। সে কারণে যারা আইন প্রয়োগ করছেন তাদের মূল বিষয়ের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। এখানে মালিক যেমনি সহায়ক শক্তি তেমনি আবার তাদের কারণেই যাত্রীরা জিম্মি। সুতরাং যাত্রীরা যাতে প্রকৃত ভাড়া দিয়ে নিরাপদে যাতায়াত করতে পারে সেটি নিশ্চিতকরণের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হবেন এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন