শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

ফ্রোজেন শোলডার বা কাঁধের ব্যথায় কার্যকরী অকুপেশনাল থেরাপি

| প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ফ্রোজেন শোলডার কি?
কাঁধে ব্যথা হওয়া বা জোড়া শক্ত হয়ে যাওয়ার অবস্থাকে আমরা সাধারণত ফ্রোজেন শোলডার বলি।
প্রথমদিকে কাঁধে ব্যথা শুরু হয়, ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে তীব্রতা বাড়ে এবং কাঁধের জোড়া শক্ত হয়ে যায়। ব্যথা এবং শক্ত হয়ে যাওয়ার প্রভাবে রোগীর প্রাত্যহিক কাজে সীমাবদ্ধতা চলে আসে। মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলে কাঁধ নাড়ানো কঠিন হয়ে পরে।
কাঁধের এই অবস্থার উন্নতি তীব্রতা এবং সময়ের উপর নির্ভর করে। মাঝেমাঝে কয়েক মাসের মধ্যে আবার কারো কারো ক্ষেত্রে বছরখানিকও লেগে যেতে পারে।
লক্ষণসমূহ
মূলত দুই ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পায়-
১) কাঁধে প্রচÐ ব্যথা অনুভ‚ত হওয়া
২) কাঁধের জোড়া শক্ত হয়ে যাওয়া
ব্যথা রোগীর জন্যে বড়ই বেদনাদায়ক হয় তখনই যখন রোগী কাঁধের জোড়া স্বাভাবিকভাবে নাড়াতে পারে না এবং দৈনিক কাজসমূহে সীমাবদ্ধতা চলে আসে। যেমন-
ক) গোসল করা
খ) জামাকাপড় পরিধান করা
গ) গাড়ি চালানো
ঘ) আরামদায়কভাবে ঘুমানো বা বিশ্রাম নেয়া
ঙ) চুলের খোঁপা বাঁধা
চ) পিঠ বা শরীরের পিছন দিক পরিষ্কার করা
ছ) মানিব্যাগ পিছনের পকেট থেকে বের করা
জ) উঁচু বা সামনের দিক থেকে কোন জিনিস নেয়া যেমন-শেলফ বা কেবিনেট থেকে কোন জিনিস নামানো, আলনা বা আলমারি থেকে কাপড় নেয়া ইত্যাদি
লক্ষণ বা সমস্যা খুব ছোট থেকে শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে তারতম্যের ভিত্তিতে কাঁধের ফাংশনাল মুভমেনট (দৈনিক যেসব কাজ সম্পাদনে কাঁধ ব্যবহার হয়) রেঞ্জ কমে যায় যার ফলে কাঁধ নাড়ানো অসম্ভব হয়ে পরে।
কেন হয় ফ্রোজেন শোলডার?
ফ্রোজেন শোলডার তখনই হয় যখন কাঁধের ভিতরের ক্যাপসুল ফুলে যায় এবং মোটা হয়। যখন এই ব্যাপারটি ঘটে তখন তা অস্পষ্ট থাকে। কাঁধের জোড়াকে বল এবং সকেট ধরনের জোড়া বলা হয়। কারণ হিউমেরাস অস্থির উপরের অংশের বল স্ক্যাপুলা বা পাখনার সকেটের সাথে সংযুক্ত থাকে।
আপনি যখন হাত মাথার উপরে উঠান তখন সেই ক্যাপসুলে টান পরে। আবার যখন হাত নিচে নামান তখন সেই ক্যাপসুল ঝুলে থাকে।
ফ্রোজেন শোলডার হলে আক্রান্ত কাঁধের ক্যাপসুলের ভিতরে স্কার টিস্যুগুচ্ছ তৈরি হতে থাকে যা মোটা হয় এবং ফুলে শক্ত হয়ে যায়। ফলশ্রæতিতে হিউমেরাস অস্থির উপরের অংশে স্থান সঙ্কুচিত হয়ে যায় এবং কাঁধকে স্বাভাবিক নাড়াচাড়া করতে দেয় না।
কারা ঝুঁকিতে আছেন?
ফ্রোজেন শোলডার কেন হয় এটা সবসময় চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। তবে কিছু ফ্যাক্টর বা বিষয় আছে যেগুলো ঝুঁকি বাড়ানোর জন্য দায়ী। যেমন-
বয়স এবং লিঙ্গ
অধিকাংশ সময় ৪০-৬০ বছর বয়সীদের এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
পূর্বে কাঁধে আঘাত বা অস্ত্রপচারের ঘটনা থাকলে
মাঝেমধ্যে ফ্রোজেন শোলডার কাঁধের বা বাহুর আঘাত যেমন ফ্র্যাকচার বা ভেঙে যাওয়া অথবা অস্ত্রপচারের পরেও শুরু হতে পারে। দীর্ঘসময় ধরে বাহু এবং কাঁধ বিশ্রামে রাখার ফলে ফ্রোজেন শোলডার এ রোগী আক্রান্ত হতে পারে। এ সময় কাঁধের ক্যাপসুল অব্যবহারের ফলে শক্ত হয়ে যায়। এই কারণে ব্যথাযুক্ত এবং আঘাতপ্রাপ্ত কাঁধকে কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। সাথে সাথে প্রাথমিকভাবে নিকটস্থ অর্থোপেডিক্স চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। তারপর দৈনিক কাজে অংশগ্রহণের ব্যাপারে অবশ্যই একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্টের পরামর্শ এবং চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হবে।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ফ্রোজেন শোলডার হবার ঝুঁকি অনেক বেশি। এর সঠিক কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে বলা হয়ে থাকে যে, ডায়াবেটিস রোগীদের দুইবার এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত রোগীর সমস্যা প্রকট আকারে দেখা যায় এবং দুই কাঁধেই সমস্যাগুলো দেখা যেতে পারে। এজন্য ডায়াবেটিস রোগীদের অবশ্যই রক্তে গøুকোজের পরিমাণ বারবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
অন্যান্য রোগ
এমন আরও কিছু রোগ আছে যেগুলোর প্রভাবে ফ্রোজেন শোলডার হতে পারে। যেমন-
ক্স হার্টের অসুখ
ক্স স্ট্রোক বা প্যারালাইসিস
ক্স ফুসফুসজনিত রোগ
ক্স হাইপার অথবা হাইপো থাইরয়ডিজম থাকলে
ক্স স্তন ক্যান্সার
এছাড়াও কাঁধের টেন্ডনে প্রদাহ হলে, কাঁধের মাংসপেশি ছিঁড়ে গেলে ফ্রোজেন শোলডার হতে পারে। হাসপাতালে কোন কারণে দীর্ঘ সময় ধরে কাঁধের নাড়াচাড়া বন্ধ থাকলেও ফ্রোজেন শোলডার হতে পারে।
ফ্রোজেন শোলডার এ কার্যকরী অকুপেশনাল থেরাপি চিকিৎসাপদ্ধতি
একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট হলিসটিক এপ্রোচ (শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, পেশাগত, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ইত্যাদি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করে) এ রোগীকে সেবা দিয়ে থাকেন। রোগীর গুণগত ও সর্বোৎকৃষ্ট সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে অকুপেশনাল থেরাপিসটগণ রোগীর জন্যে থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ, অর্থবহ এবং উদ্দেশ্যমূলক কাজে অংশগ্রহণ, সহায়ক সামগ্রী প্রদান, স্বাস্থ্য উপযোগী কর্মপরিবেশ নির্ধারণ, শিক্ষামূলক তথ্য প্রদান, দৈনিক কাজের প্রশিক্ষণ, কর্ম বিশ্লেষণ, উপযুক্ত কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানিয়ে নেয়া, রোগ এবং চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণায় নিযুক্ত থাকেন। ফ্রোজেন শোলডার এ আক্রান্ত রোগীর জন্যে অকুপেশনাল থেরাপিস্ট যা করে থাকেন-
১) এসেসমেনট বা সমস্যা নির্ধারণ-রোগীর শারীরিক সামর্থ্য, মানসিক লেভেল, পেইন লেভেল, অকুপেশনাল পারফরম্যান্স লেভেল বা কর্মদক্ষতার লেভেল বের করেন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট
২) চিকিৎসা পরিকল্পনা- সমস্যা পর্যালোচনা করে একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছকে লিপিবদ্ধ করেন। আধুনিক গবেষণাগুলো বলছে, অকুপেশনাল থেরাপির নেয়ার ফলে ফ্রোজেন শোলডার এ আক্রান্ত রোগীর ১০-১২ সেশন পর ব্যথা দূরীভূত হয়ে দৈনিক কাজের পারফরম্যান্স লেভেল স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। তবে এটা নির্ভর করে রোগীর ব্যথার তীব্রতা, সময় এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার উপর।
৩) চিকিৎসা প্রয়োগ-
# পেইন ম্যানেজমেনট- রোগীর ব্যথার তীব্রতা বিবেচনা করে অকুপেশনাল থেরাপিস্ট হট প্যাক অথবা কোল্ড প্যাক অথবা অন্য কোন ডিভাইস ব্যবহার করবেন। আমাদের অনেকেরই একটা ভুল ধারণা আছে। আর সেটা হচ্ছে কাজ করলে ব্যথা বেড়ে যাবে। রোগী কঠিন, মাপকাঠির বাইরে, উদ্দেশ্যহীনভাবে কাজ করলে রোগীর ব্যথা বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তাহলে রোগী কোন ধরনের কাজ করতে পারবে, কি কাজ করতে পারবে, কি কাজ করতে পারবে না, একটা নির্দিষ্ট কাজ সহজ থেকে কিভাবে কঠিনের দিকে যাবে, ব্যথানাশক কাজ কোনগুলো হবে এসব নির্ধারণ করে, প্রশিক্ষণ দিয়ে, শিক্ষামূলক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে রোগীকে গাইড করবেন একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট। কারণ একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট একটিভিটি এনালাইজার, অকুপেশনাল হেলথ এক্সপার্ট, একটিভিটিজ অব ডেইলি লিভিং ট্রেইনার, একটিভিটি এডুকেটর।
# একটিভিটি এনালাইসিস ও গ্রেডেশান- রোগীর দৈনিক যে কাজগুলো সম্পাদন করতে সমস্যা হচ্ছে সেগুলো প্রত্যেকটি আলাদাভাবে ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করবেন একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট। ধাপগুলোতে ধীরে ধীরে উদ্দেশ্যমূলক ও অর্থবহ ছোট ছোট কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে রোগীকে স্বাবলম্বী করবেন। এটা অনেকটা সিঁড়ির মত যেখানে রোগী ছোট ছোট কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বড় একটি কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে পারবেন।
# সিবিটি এপ্রোচ- দীর্ঘদিন ধরে শরীর এ ব্যথা বসবাস করলে তার বিরূপ প্রভাব পরে মনে, মস্তিষ্কে এবং আচার আচরণে। অকুপেশনাল থেরাপিস্ট সিবিটি এপ্রোচ এর মাধ্যমে রোগীকে সামগ্রিকভাবে ব্যথামুক্তভাবে জীবনযাপন করার কৌশল রপ্ত করান।
# ছোট ছোট এবং বড় বড় কাজ-অকুপেশনাল থেরাপিস্ট দ্বারা নির্বাচিত এবং নির্ধারিত যে কাজগুলোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে রোগীকে প্রধান কাজে স্বনির্ভর করে তোলা হয়।
# প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষণ- অকুপেশনাল থেরাপিস্ট রোগীকে কাজের ধরন শুধু দেখিয়েই দেন না, বাড়িতে কিংবা কর্মস্থলে কিভাবে এক একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করবেন সে ব্যাপারে উপযুক্ত তথ্য এবং পরামর্শ প্রদান করে থাকেন।
সতর্কতা
সুস্থ কিংবা অসুস্থ কিংবা প্রতিবন্ধিতা নিয়ে আপনার প্রতিটি কাজ অর্থাৎ যতœমূলক, আয়বর্ধক কাজ এবং অবসরমূলক কাজ ধাপে ধাপে, সহজ থেকে কঠিন কীভাবে সুষ্ঠু ও নিয়মমাফিক সম্পাদন করবেন সে ব্যাপারে আপনাকে ভালভাবে গাইড করবেন একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট। কাজেই এই বিষয়ে কুসংস্কার বা অন্য কারো মতামত গ্রহণ করা থেকে সাবধান থাকুন।
২) আপনার বা আপনার পরিচিত কারো এ সমস্যাগুলো থাকলে এখুনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।
শম ফারহান বিন হোসেন
ক্লিনিক্যাল অকুপেশনাল থেরাপিস্ট,
অকুপেশনাল থেরাপি বহির্বিভাগ,
সিআরপি-মিরপুর, ঢাকা।
মোবাইল : ০১৬৮৫৬৫৬১৯৯

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন