সরকার জনস্বার্থে করোনারি স্ট্যান্টের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর প্রতিবাদে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা হাসপাতালগুলোতে রিং সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে শত শত হৃদরোগীর জীবন সংশয় দেখা দিয়েছে। রিং সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় গত দু’তিন দিনে সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে ওটি সিরিয়ালে থাকা জরুরী রিং পরানো রোগীদের চিকিৎসা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন ডাক্তাররা। এর ফলে শত শত হৃদরোগীর জীবন অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে পতিত হয়েছে। দেশের লাখ লাখ হৃদরোগী দীর্ঘদিন ধরেই চিকিৎসা বিষয়ক অসাধুচক্র এবং হার্টের রিং (মেটাল স্টেন্ট) আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হচ্ছে। দেশে বিশ্বমানের হৃদরোগ চিকিৎসা প্রযুক্তি, দক্ষ ডাক্তার এবং আধুনিক হাসপাতাল ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও এসব অসাধু অতিলোভী মুনাফাবাজ ব্যবসায়ীর কারণে হৃদরোগের চিকিৎসা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। বিশেষত: করোনারি বøক’র চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত মেটাল স্টেন্ট (রিং)-এর মূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বহুগুণ বাড়িয়ে বিক্রির কারণে দেশে হৃদরোগের সার্জারি ব্যয় অস্বাভাবিক বেশী। হৃদরোগীদের নিয়ে এমন অনৈতিক বাণিজ্য বন্ধ করতেই সরকারের সংশ্লিষ্টরা প্রতিটি ডিএস স্ট্যান্টের মূল্য সর্বোচ্চ ২৫ হাজার এবং ড্রাগ ইলিওটিং স্ট্যান্টের মূল্য ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেয়। ইতিপূর্বে চারটি আমদানিকারণ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও এই মূল্যে স্ট্যান্ট সরবরাহের প্রস্তাব করা হয়েছিল বলে জানা যায়। যদিও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে করোনারি স্ট্যান্টের দাম মান ভেদে ৭ হাজার থেকে ২৯ হাজার টাকার মধ্যে।
করোনারি স্ট্যান্টের সরকার নির্ধারিত মূল্যও তুলনামূলকভাবে বেশী বলে বিবেচিত হওয়ায় আগামীতে এসব পণ্যের মূল্য আরো কমিয়ে আনার আশাবাদ পাওয়া যাচ্ছে। আট হাজার থেকে তিরিশ হাজার মূল্যের হার্টের রিং বসাতে বাংলাদেশে ৮০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত রোগীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। ব্যয় কমাতে এবং ভালমানের চিকিৎসার প্রত্যাশায় প্রতিমাসে হাজার হাজার রোগী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রায় বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। অথচ চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং হাসপাতালের অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করা গেলে এসব রোগীর বিদেশে চলে যাওয়ার কোন কারণ থাকতো না। বাংলাদেশে বিশ্বমানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও নতুন নতুন হাসপাতাল থাকলেও অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে মানুষ প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের অনৈতিক মুনাফা বাণিজ্যের কারণে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, বিএসএমএমইউ, ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হসপিটালের মত প্রতিষ্ঠানেও চিকিৎসা ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক রোগী ব্যয় কমানোর জন্য ভারতমুখী হতে বাধ্য হয়।
মূল্য নির্ধারনের পাশাপাশি পণ্যের রেজিস্ট্রেশন, পরিচিতি, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখসহ প্যাকেটের গায়ে পণ্য মূল্যের উল্লেখ থাকার যে বিধান সরকার বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে তা’ খুবই প্রশংসনীয়। আরো অনেক আগেই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ বাঞ্ছনীয় ছিল। তবে সরকারের এই মহতি উদ্যোগটিও স্ট্যান্ট আমদানিকারক ও বিক্রেতাদের দাবির কাছে ব্যর্থ হয়ে যাবে কিনা তা নিয়ে জনমনে কিছুটা সংশয় তৈরী হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার গণপরিবহনে সরকারের কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘটের কারণে কার্যত ব্যর্থ হতে বসেছে। এসব ব্যর্থতার নেপথ্যেও সরকারের কতিপয় মন্ত্রীর নেপথ্য ভূমিকার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অতীতে সরকারী হাসপাতালে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ইন্টার্ন ডাক্তারদের ধর্মঘটে হাজার হাজার রোগীর নিদারুণ দুর্দশায় পড়তে দেখেছি আমরা। শুধু ইন্টার্নি ডাক্তাররাই নয়, রাজনৈতিক দলবাজি ঢুকে গেছে দেশের সর্বোচ্চ ডাক্তারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিএসএমএমইউ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ স্তরেও। গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যায়, হাসপাতালের সরকার সমর্থিত ডাক্তার সংগঠন স্বাচিপের নেতৃবৃন্দ, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যদের মধ্যকার দ্ব›েদ্ব বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পড়েছে এই বিশেষায়িত হাসপাতালটি। হার্টের রিংয়ের মূল্য নির্ধারণকে যখন দেশবাসি স্বাগত জানিয়েছে, দেশের হাজার হাজার দরিদ্র হৃদরোগী সুলভে চিকিৎসা লাভের আশায় বুক বাঁধছেন, তখন আমদানিকারক ও ব্যবসায়িরা স্ট্যান্ট সরবরাহ বন্ধ রেখে ডাক্তার ও রোগীদের জিম্মি করে সিদ্ধান্ত বদলাতে চাইছে। এ ধরনের তৎপরতা অযৌক্তিক, অমানবিক ও নৈতিকতার পরিপন্থী। প্রয়োজনে এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হোক। হৃদরোগী, ক্যান্সার ও কিডনী রোগীদের ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ডায়গনোস্টিক ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আরো উদ্যোগ ও নজরদারি বাড়াতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন