কুমিল্লার মুরাদনগরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্র্মীদের অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব-সংঘাতের জের হিসেবে দু’জন খুন হয়েছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডার বাণিজ্য, বালু ব্যবসা, মাদক কারবার ইত্যাদি নিয়ে পরস্পর বিরোধী দু’গ্রুপের দীর্ঘ বিরোধের ধারাবাহিকতায় এ দু’জন খুন হয়েছে। নরসিংদী রায়পুরার দুর্গম চরাঞ্চলে আওয়ামী লীগের দুই লাঠিয়াল বাহিনীর বন্দুক ও টেঁটাযুদ্ধে দু’জন নিহত হয়েছে। এই ঘটনায় এলাকায় লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা আওয়ামী লীগের দু’গ্রæপের যুদ্ধংদেহী তৎপরতার প্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করতে বাধ্য হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রামে ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান মেয়র ও সাবেক মেয়রের দ্ব›েদ্ব আউটার স্টেডিয়ামে সুইমিংপুল নির্মাণকে কেন্দ্র করে যুবলীগের এক কর্মী নিহত হয়েছে। ওই ঘটনায় পুলিশ-ছাত্রলীগের মধ্যকার সংঘর্ষে পুলিশসহ কয়েকজন আহত হয়েছে। অতঃপর, বর্তমান ও সাবেক মেয়রের মধ্যে সমঝোতাও ভেঙে গেছে। দু’পক্ষের মধ্যে ফের সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ প্রভৃতি সংগঠনের মধ্যে দ্ব›দ্ব-সংঘাত, রক্তপাত ও প্রাণহানির ঘটনা প্রায়ই ঘটেছে। এটা ক্ষমতাসীনদের জন্য কতটা উদ্বেগজনক আমরা জানি না। তবে আইন-শৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই উদ্বেগজনক।
ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর পারস্পরিক বিরোধ ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এ পর্যন্ত কতজন হতাহত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ক্ষমতাসীরা এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাগাতার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হয়, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মধ্যকার সংঘাত-সংঘর্ষে এ পর্যন্ত যত লোক হতাহত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশী লোক হতাহত হয়েছে ক্ষমতাসীন দল ও সংগঠনগুলোর পারস্পরিক ও অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব-সংঘাত ও সংঘর্ষে। কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষকরা অবশ্যই লক্ষ্য করে থাকবেন, প্রভাববলয় বিস্তার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জবরদখল, কমিশন বাণিজ্য, মাদক ব্যবসা ইত্যাদিই এই বিরোধ-বিসম্বাদ ও হতাহতের প্রধান কারণ। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই সব গুরুতর অপরাধ ও হত্যাকান্ডের ঘটনা ক্ষমতাসীন দল ও মহল মোটেই রুখতে পারছে না। দলের তরফ থেকে অপরাধকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে পারছে না বা নেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নিচ্ছে না অথবা যে কারণেই হোক, নিতে পারছে না। দল বা সংগঠনগুলোর মধ্যকার দুষ্টচক্র এক ধরনের অভয় সুবিধা এবং দায়মুক্তি উপভোগ করছে। দলের শীর্ষ নেতারা অপরাধ ও অঘটনের প্রেক্ষিতে এমন সব মন্তব্য করছেন, যার আসলে কোনো মানেই হয় না। কখনো বলছেন, দলে হাইব্রিড নেতাদের প্রাধান্য বেড়েছে। কখনো বলছেন, দলে কাউয়া ঢুকেছে। আবার কখনো বলছেন, দলে ফার্মের মুরগী ঢুকেছে। প্রশ্ন উঠে, যদি হাইব্রিড, কাউয়া ও ফার্মের মুরগীরাই দলে ঢুকে থাকে এবং শীর্ষ নেতারা তা জেনে থাকেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন, বা তাদের দল থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে না কেন? আসলে এসব কথার কথা মাত্র। ব্যর্থতা ঢাকা দেয়ার একটা দুর্বল কৌশল মাত্র।
দল ও সংগঠনগুলো শীর্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের শক্ত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে যে নেই, বাস্তবতা তারই প্রমাণ বহন করে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও ঐতিহ্য সম্পর্কে কম-বেশী সকলেই জ্ঞাত। যারা বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল তারা এও জানেন, দলটির দুটি চেহারা রয়েছে। যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে তখন একটি চেহারা। যখন ক্ষমতায় থাকে তখন আরেকটি একটি চেহারা। ক্ষমতায় গেলে দলটির এক শ্রেণীর নেতাকর্মী বেপরোয়া ও বেদিশা হয়ে পড়ে। এমন কোনো অপকর্ম নেই, অপরাধ নেই যা তারা করে না। এতে দলের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ও ভূমিকা ম্লান হয়ে যায়। বর্তমান শীর্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের এ বিষয়টি গভীরভাবে আমলে নেয়া উচিত। শুধু মুখে বললেই হবে না যে, অপরাধ-অপকর্ম যেই করুক, তার রেহাই হবে না; কার্যক্ষেত্রে এ ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হবে। অপরাধী ও অন্যায়কারীর দায় দল নিতে পারে না। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নেতৃত্বেরই দায়িত্ব। এ দায়িত্ব যত কঠিনই হোক, পালন করতে হবে। দলীয়ভাবে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দখলবাজ, কমিশনবাজ ও মাদক কারবারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তার মত করে কাজ করতে দিতে হবে। যেই অপরাধ করুক, অন্যায় করুক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার সুবিধা নিচ্ছে বা পাচ্ছে দলের ওই শ্রেণীর নেতাকর্মী যারা বিভিন্ন অপকর্ম ও অঘটনে বেপরোয়া, বেতোয়াক্কা। তাদের রাশ টানতে হবে। দলীয় স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এর বিকল্প নেই। আইনের শাসন ও সুবিচার নিশ্চিত করা গেলে স্বাভাবিকভাবেই হত্যা-সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দুষ্কৃৃতি, অপরাধ, অপকর্ম ও অঘটন হ্রাস পাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন