অতিবর্ষণ বা স্বল্পক্ষণের বৃষ্টিতে নগরী তলিয়ে যাওয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। বছরের পর বছর ধরে এ পরিস্থিতি চলছে। ন্যূনতম কোনো উন্নতি নেই। দেশের দুই প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিত্যকার। গত শুক্রবার দুই ঘণ্টার ভারি বর্ষণে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে কী ভয়াবহ পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে, তার সচিত্র প্রতিবেদন গতকালের প্রায় সবকটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। প্রধান প্রধান এলাকা ও সড়কে মানুষকে কোমর সমান পানির মধ্যে চলাফেরা করতে হয়েছে। রাস্তা-ঘাট তো বটেই বাসা-বাড়িতে পর্যন্ত পানি ঢুকে যায়। অসময়ের এই অতিবর্ষণে যে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়, তা ছিল অবর্ণনীয়। চট্টগ্রাম নগরীর এ পরিস্থিতিতে মেয়র দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, এ সমস্যা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। বলা বাহুল্য, মেয়রের এ ধরনের অজুহাত দুর্ভোগে পড়া মানুষের কষ্টকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথাগতভাবেই তিনি পানিবদ্ধতা নিরসনের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে নগরবাসী এ আশ্বাসে খুশি হতে পারেনি। তারা বলছেন, ২০-২৫ বছর ধরেই এমন আশ্বাস শুনে আসছেন। আশ্বাসের বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমান মেয়রও নির্বাচনের সময় চট্টগ্রামের পানিবদ্ধতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুততম সময়ে তা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে, দুই বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও সমস্যার ন্যূনতম সমাধান হয়নি।
বাংলাদেশ উন্নয়শীল দেশ। প্রতি নিয়ত উন্নতির কথা বলা হচ্ছে। অথচ রাজধানীসহ এমন একটি শহর সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি যা দেখে মানুষ মুগ্ধ হতে পারে। শুকনো মৌসুমে পরিণত হয় ধুলোর শহরে আর বর্ষা মৌসুমে পানিবদ্ধতা ও কাদামাটির শহরে। কোনো মৌসুমেই নগরবাসীর স্বচ্ছন্দে চলার মতো পরিবেশ থাকে না। আমরা এত উন্নতি করছি, অথচ রাজধানী ঢাকা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের রাজধানী চট্টগ্রামকে পর্যন্ত বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারছি না। এক পানিবদ্ধতারই নিরসন করতে যুগের পর যুগ কেটে যাচ্ছে। বৃষ্টির সময় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে দুটো নগরীতে নৌকা পর্যন্ত চলাচল করতে দেখা যায়। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, নগর দুটির পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা কতটা নাজুক। আবার বছরের পর বছর পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক করার খোঁড়াখুঁড়ির কার্যক্রমও দেখা যায়। তারপরও কোনো উন্নতি নেই। দায়িত্বে যারা থাকেন, তারা কেবল আশ্বাসের কথাই বলে যান। এ জন্য শত শত কোটি টাকাও বরাদ্দ করা হয়। চট্টগ্রাম নগরীর পানিবদ্ধতা নিরসনে গত ১৪ বছরে ৩০৪ কোটি টাকা ব্যয় হলেও ন্যূনতম উন্নতি হয়নি। এ অর্থ যে পানিতে গেছে তা বোধকরি ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই। এভাবে প্রতিবছরই অর্থ বরাদ্দ হয়, তবে নগরবাসীর দুঃখ গোছে না। অর্থ খরচ হয়, কাজ হয় না, এমন নজির বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। অর্থের এই অপচয় সহ্যও করা হচ্ছে। রাজধানীর দশা আরও করুণ। শহরটি বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অনুপযোগী ও অযোগ্য হলেও এর উত্তরণে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি চোখে পড়ে না। ধুলিময় এবং পানিবদ্ধ নগরী হয়েই রয়েছে। বছরের পর বছর পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে বিশাল বিশাল পাইপ বসানোর কাজ চললেও তার কোনো উন্নতি চোখে পড়ে না। এসব কাজে শত শত কোটি টাকা খরচ হলেও, এ অর্থ কোথায় যায়, তার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। জনদুর্ভোগ চরমে উঠলে নগর কর্তৃপক্ষের মুখ থেকে কেবল আশ্বাসের কথা শোনা যায়। অসময়ের বর্ষণে চট্টগ্রাম ও ঢাকার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে যে কী অবস্থা হবে, তা এখনই বলে দেয়া যায়। এ পরিস্থিতি আর কতকাল চলবে, তার কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।
চট্টগ্রামে কয়েক ঘণ্টার বর্ষণে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সিটি করপোরেশনের কোনো অজুহাতই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মেয়রের প্রতিশ্রুতি সত্তে¡ও পানিবদ্ধতা নিরসনের কেনো ন্যূনতম উন্নতি হয়নি কেন, তা মেয়রকেই খুঁজে বের করতে হবে। এ কাজে যে অর্থ ব্যয় হয়, তা কোথায় কিভাবে ব্যয় হচ্ছে, তার খোঁজ নেয়াও তার দায়িত্ব। বছরের পর বছর অর্থ বরাদ্দ হবে, পানিবদ্ধতার কোনো উন্নতি হবে না, এটা বরদাশত করা যায় না। আমাদের কথা স্পষ্ট, নগরীর পানিবদ্ধতা নিরসন করে নগরবাসীর স্বস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য যেসব প্রকল্প হাতে নেয়া প্রয়োজন, তা নিতে হবে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। কাজ করব না, কেবল দুঃখ প্রকাশ করব- এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। নগরবাসী দুঃখ প্রকাশ চায় না, তারা চায় নগর কর্তৃপক্ষের কার্যকর উদ্যোগ এবং তার বাস্তবায়ন। তাদের দুর্ভোগের মধ্যে দুঃখ প্রকাশ কাঁটা গায়ে নুনের ছিঁটা দেয়ার শামিল। আমরা আশা করব, উভয় নগর কর্তৃপক্ষ জনদুর্ভোগের বিষয়টি আমলে নিয়ে আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আগেই পরিস্থিতি সহনীয় করতে উদ্যোগী হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন