ভারত থেকে আসা বানের পানিতে ভেসে গেছে হাওর। গত সোমবার পানির তোড়ে পাকনার হাওর ডুবে যাবার ফলে ১৪২ টি ফসলি হাওরের সবক’টির ফসল ডুবে গেছে। তলিয়ে গেল দেড় লাখ হেক্টর জমির বোরো ফসল। এবার জেলায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। ধানের (চালের) লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন আবাদকরা ধানের প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, প্রকৃতি অস্বাভাবিক আচরণ করছে। পরিস্থিতি আরো আশঙ্কাজনক ও উদ্বেগের। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই প্রকৃতি এ অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে বৃষ্টিপাতে হাওরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অরো ভয়াবহ হতে পারে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এই বন্যাই শেষ বন্যা নয় বর্ষা শুরুর আগে আরো বন্যা হবার আশঙ্কা রয়েছে। চলতি মাসে ইতোমধ্যেই ত্রিশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এবছরে এখন পর্যন্ত বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চাইতে ১১৯.৭ শতাংশ বেশি হয়েছে। গতবছরের চিত্র ছিল একবারে উল্টো। গতবছর ছিল বৃষ্টিহীনতা। অত্যধিক গরম। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত একটি দৈনিককে জানিয়েছেন, এখনকার অতিবৃষ্টি ও এর আগের বছরের গরম বৃদ্ধি পাওয়া- দুটোই আশঙ্কাজনক। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতিতে এ অস্বাভাবিকতা দেখা দিয়েছে। এর জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে হাওরের অবদান ৬ শতাংশ। সেই হাওর এখন বিরাণভূমি। কৃষকের ধান এখন পানির নিচে। মরছে মাছ, হাঁস। খামারের হাঁস-গবাদিপশুও বিক্রি করতে পারছে না। মানুষের পাশাপাশি গো খাবারেরও চরম সংকট দেখা দিয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, পানিদূষণে ৪১ কোটি টাকার ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ মারা গেছে। ৩ হাজার ৮৪৪টি হাঁস মারা গেছে। ৬ টি উপজেলার ৫৫ টি ইউনিয়নের ১৮ হাজার ২০৫ টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বলা হচ্ছে, এগুলো কেতাবি হিসাব। বাস্তব অবস্থা আরো ভয়াবহ। আর্থিকভাবে এই ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা হবে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। হাওর নিয়ে কাজ করা ৩৫ টি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ওই সংস্থাটি বলছে, মূলত সরকার উৎস থেকে নেয়া তথ্য দিয়ে তারা হিসাব তৈরি করেছেন। ইতোমধ্যেই সরকারি হিসাব ও বেসরকারি হিসাবের মধ্যে গরমিল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তেমনি মাছ ও হাঁসের মড়কের কারণ নিয়েও পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় হাওর এলাকাকে জাতীয় দুর্যোগপূর্ণ এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার নেতা সুলতানা কামাল। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের রক্ষায় দ্রæত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। হাওরের উন্নয়ন ও গবেষণা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, এই ক্ষতির প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, হাওরের ফসলহানির কারণে ইতোমধ্যেই দেশের অভ্যন্তরে চালের সরবরাহে সংকট দেখা দেয়ায় চালের চাম বাড়তে শুরু করেছে। এর সাথে দেশের মৎস্য সম্পদের যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার নানামাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়বে। হাওর অঞ্চলে বান-বন্যা নতুন কিছু নয়, তবে এবারে যেটি হয়েছে তারমধ্যে মারাত্মক অস্বাভাবিকতা রয়েছে। আর্ত কৃষকরা সব হারিয়ে বলছে আর সাতটাদিন সময় পাওয়া গেলেও অন্তত অনেক ফসল ঘরে তোলা যেত। এই অসময় বন্যার কারণ নিয়েই মূল আলোচনা। পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের উপ-নির্বাহী পরিচালক মমিনুল হক বলেছেন, এই অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টি অস্বাভাবিক। প্রকৃতির এই অস্বাভাবিক আচরণ জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকেই নির্দেশ করে। ড.আইনুন নিশাত মনে করেন, শরৎ ও হেমন্ত হারিয়ে এক হয়ে গেছে। শীত কমে গেছে। দেখা যাচ্ছে ষড়ঋতুর দেশে গ্রীষ্ম, বসন্ত ও হেমন্ত প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। এসব কিছুই জলবায়ু পরিবর্তনের একেকটি নির্দেশক।
প্রতিবেশীর বৈরী পানি নীতির কারণে অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ বিরূপ আবহাওয়ার শিকার হয়ে আসছিল। একথা বহুবার বহুভাবে বলা হয়েছে যে, পানির ন্যায্য হিস্যা না পেলে বাংলাদেশ টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়তে পারে। পানির অভাবে মরুকরণ প্রক্রিয়ার বিষয়টিও অনেক আগে থেকেই বলা হয়ে আসছে। নদ-নদীর উজানে ভারতীয় বাঁধের কারণে সেদেশেও অনেক অঞ্চলের অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশে যা ঘটছে তাকে অমানবিক মনে না করার কোন কারণ নেই। শুষ্ক মৌসুমে চলছে পানির অভাব আর বর্ষায় হচ্ছে বন্যা। যখন খুশি ভারত পানি ছেড়ে দেবে, যখন খুশি আটক রাখবে- এই স্বেচ্ছাচারিতারই মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বর্তমান বন্যায় দেশের কৃষি এবং সার্বিকভাবে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তার দায় থেকে ভারতের মুক্ত হবার কোন সুযোগ নেই। হাওর অঞ্চলের মানবিক বিপর্যয়ের কারণে গোটা দেশের অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তার ভার বইতে হবে দেশের মানুষের। বাস্তবত, পরিস্থিতিকে কেবল আপদকালীন মনে করার কোন কারণ নেই। এ অবস্থা অনেকটা যেন লেগেই রয়েছে। যতক্ষণ পানি সমস্যার কার্যকর সমাধান করা না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এসমস্যারও কোন সমাধান করা সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে, সরকারের সংশ্লিষ্টরা প্রতিবেশীর থেকে পানি আনার ব্যাপারে এপর্যন্ত কোন সফলতা দেখাতে পারেননি। অন্যদিকে পানি ব্যবস্থাপনা নিয়েও এপর্যন্ত যত আলোচনা হয়েছে তাতেও কোন সফলতা আসেনি। সব মিলে সঙ্কট কেটে যাবে সেরকম কোন আলামত এখনো স্পষ্ট নয়। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন সময় ক্ষেপণের আর বিন্দুমাত্র সময় নেই। এখনই মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে। কার্যত সংশ্লিষ্টদের কোন প্রস্তুতি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বিষয়টিকে দু’ভাবে দেখতে হবে। হাওর অঞ্চলে যে বিপুল ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে উঠতে সেখানকার মানুষকে সর্বাত্মক সহায়তা ও সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। সরকারের নানা জনে নানা কথা বলছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, সব খুইয়ে হাওরের মানুষ এখন পথে বসেছে। যারা দেশের অর্থনীতির জন্য সম্পদ বলে বিবেচিত তারা এখন বোঝায় পরিণত হয়েছেন। তাদেরকে চাঙ্গা করে তুলতে সর্বাত্মক কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। তবে বিষয়টিকে এভাবে দেখেই শেষ করা অনুচিত। মূল বিষয়ে যেতে হবে। বাংলদেশে যে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিতে শুরু করেছে তার মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না গেলে আপতকালীন কর্মসূচী কোন সুফল দেবে না বা দিতে পারবে না। সে দিকেই সকলকে নজর দিতে হবে। ভাবার রয়েছে আর কতদিন বিনাদোষে দেশের মানুষ প্রতিবেশীর বৈরী আচরণের শিকার হয়ে থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন