নূরুল ইসলাম : অফিস ছুটির পর সন্ধ্যায় ফুটপাতে বসবে হকাররা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এই নিয়ম দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে। সন্ধ্যা তো দূরে থাক দুপুর হতে না হতেই ফুটপাত দখল করে বসে যায় হকাররা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের গুলিস্তান, মতিঝিল ও আশপাশের এলাকার ফুটপাতের চিত্র এটি। ফুটপাত থেকে কোটি কোটি টাকার চাঁদাও তোলা হচ্ছে আগের মতোই। চাঁদার নেপথ্যে স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টির একাধিক নেতা। অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আলোচিত তেজগাঁও স্ট্যান্ডটি আবারও দখল হতে চলেছে। দেড় বছর আগে দিনভর বাধা, সংঘর্ষ আর উত্তেজনার মধ্য দিয়ে উদ্ধার করা হয় এ স্ট্যান্ডটির অবৈধ দখলকৃত জায়গা। মূল সড়কে সারি করে ট্রাক, লড়ি ও পিকআপ ভ্যান রাখা হয়েছে। ফুটপাত দখলের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, এটা মাঝে মাঝে হচ্ছে। তবে যাতে না হয় সে জন্য আমাদের প্রচেষ্টাও আছে। তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিনই গুলিস্তান, মতিঝিল এলাকায় হকার উচ্ছেদ অভিযান চলছে। স্থায়ীভাবে কেউ যাতে ফুটপাত দখল করতে না পারে সেজন্য আমাদের কঠোর নজরদারি আছে। অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, বিষয়টা আমিও জেনেছি। তবে আমি থাকতে আবার দখল হতে দেবো না। দেড় বছর আগের উচ্ছেদের ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, এটা আর হতে দেয়া যায় না।
রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টনসহ আশপাশের এলাকার রাস্তার ফুটপাত পথচারীদের চলাচলের জন্য ফাঁকা থাকে না কখনও। সকালে হকাররা ফুটপাতে বসে ডালা ও টুকরি নিয়ে। শুধু ফুটপাত নয়, গুলিস্তান স্কয়ার থেকে ফ্লাইওভার পর্যন্ত সিংহভাগ রাস্তাই দখল করে রাখে হকাররা। সাথে সারি সারি রিকশা তো আছেই। সবমিলে হকারমুক্ত ফুটপাত ও রাস্তা এখন আর নেই। হকারদের কারণে গুলিস্তান এলাকায় সকাল থেকে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট। ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিরসনে তৎপর হলেও হকারদের সরানোতে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। ফুটপাতকে ঘিরে আগের মতোই সক্রিয় চাঁদাবাজরা। শুধুমাত্র গুলিস্তান ও মতিঝিল এলাকার ফুটপাত থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাও উঠছে আগের মতোই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চাঁদাবাজির নেপথ্যে রয়েছে ১০, ১৩ ও ২০ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ, যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা। আছেন ওয়ার্কার্স পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি, এমনকি বিএনপির নেতাও। ভুক্তভোগীদের মতে, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদ করেছেন ঠিকই। কিন্তু হকাররা সন্ধ্যার আগে যাতে বসতে না পারে সেজন্য ডিএসসিসির কোনো তদারকি না থাকার কারণে আগের অবস্থা ফিরে আসছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরাই তাদের চাঁদাবাজিকে টিকিয়ে রাখার জন্য এসব কাজ করছে। তারা আগের মতোই চাঁদাবাজি করছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এসব চিহ্নিত চাঁদাবাজদের গ্রেফতার দাবি করে আসছি।
সরেজমিনে গুলিস্তান এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকেই গুলিস্তান স্কয়ার থেকে সুন্দরবন স্কয়ার পর্যন্ত ফুটপাতে হকাররা ডালা বা টুকরি নিয়ে বসে। সকাল ১০টার পর থেকে ফুটপাত দিয়ে পায়ে হাঁটার মতো আর অবস্থা থাকে না। একইভাবে এই এলাকার রাস্তাও দখল করে নেয় হকাররা। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নেমে গাড়িগুলো জিপিওর দিকে যেতে গিয়ে প্রথমেই সুন্দরবন স্কোয়ারের সামনে যানজটে পড়ে। সুন্দরবন স্কোয়ার থেকে ফুলবাড়ীয়ার দিকে যাওয়ার রাস্তাও দখল করে রাখে জুতা ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ওই রাস্তায় যানবাহন চলাচল করতে পারে না। তবে সকালে জিপিওর উল্টোদিকে জাসদ অফিসের সামনে থেকে আওয়ামী লীগের অফিস পর্যন্ত ফুটপাতে কোনো হকার বসে না। অন্যদিকে, জিপিও থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদ স্বর্ণ মার্কেট পর্যন্ত ফুটপাত হকাররা সকাল থেকেই দখলে রাখে। হকাররা জানায়, এই অংশ নিয়ন্ত্রণ করে ছিন্নমূল হকার্স লীগের সাবেক সভাপতি কামাল সিদ্দিকী। নিবন্ধনবিহীন সংগঠনের ওই নেতার স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের দু’জন নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে চলে বলে হকাররা জানায়। তবে এ বিষয়ে কামাল সিদ্দিকীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সকাল থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ফুটপাত দখল করে রাখার পর দুপুর হতে না হতেই হকাররা ফুটপাত দখল করে ফেলে। গুলিস্তানের হকার রাসেল জানায়, জোহরের নামজের আযান দিলেই সবাই চৌকি নিয়ে হাজির হয়। এরপর সেই চৌকি ফুটপাতের উপর বসিয়ে সাজগোজের কাজ করতে করতে দুইটা বেজে যায়। এরপর পুরোদমে চলে বেচাকেনা। বহুদিন ধরেই দুপুর হতে না হতেই হকাররা ফুটপাতে বসছে জানিয়ে গুলিস্তান এলাকায় ডিউটিরত এক ট্রাফিক পুলিশ বলেন, ওদেরকে উচ্ছেদ করে কার্যত যানজটের কোনো উন্নতি হয়নি। কারণ ওরা পিকআওয়ারের আগেই বসে পড়ে। তখন কাস্টমারও ভিড় করে। অন্যদিকে, মতিঝিলের ফুটপাতেরও একই অবস্থা। শাপলা চত্বর থেকে মধুমিতা সিনেমা হল পর্যন্ত রাস্তার এক পাশ দখল করে রাখে হকাররা। তবে এই অংশে হকার বসে দুপুরের পরে। কিন্তু শাপলা চত্বরের আশেপাশে সোনালী ব্যাংকের সামনে পেছনে এবং আলিকোর গলিতে হকাররা বসে সকাল থেকেই। দুপুরের পর মতিঝিল এলাকা দেখলে মনেই হবে না যে এটি হকারমুক্ত। ভুক্তভোগীরা জানান, দুপুরের পর মতিঝিলের ফুটপাত দিয়ে পায়ে হাঁটার মতো আর অবস্থা থাকে না। দুপুরের পর শুরু হয় রাস্তা দখল। বিকালে মতিঝিল এলাকায় সৃষ্ট যানজটের প্রধান কারণ হকারদের রাস্তা দখল। মতিঝিলের হকার তোফাজ্জল বলেন, সিটি কর্পোরেশন যখন হকার উচ্ছেদ করে তখন অনেকটা কড়াকড়ি ছিল। সূর্য্য ডোবার আগে কেউ বসতে পারতো না। এখন আর তা নেই। এখন দুপুরের মধ্যে বসলেও কেউ কিছু বলে না। সুযোগ পেয়ে একে একে সবাই বসে। এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি মেয়র সাঈদ খোকনের কাছে জানতে চাইলে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, সব জায়গায় বসে না, তবে কিছু কিছু জায়গায় বসে। এটা আমাদের নলেজে আছে। মেয়র বলেন, অনেক দিন ধরে চলে আসা একটা জিনিস উঠাতে গেলে সময় লাগবে-এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। স্থায়ীভাবে কাউকে ফুটপাত দখল করতে দেয়া হবে না।
অন্যদিকে হকাররা অভিযোগ করে বলেছেন, চিহ্নিত চাঁদাবাজ লাইনম্যানরা ফুটপাতে আগের মতোই চাঁদা আদায় করছে। চাঁদা না দিলে সন্ত্রাসী দিয়ে হকারদের হুমকি-ধমকি ও মারধর করা হচ্ছে বলে কয়েকজন হকার অভিযোগ করেছেন। তারা জানান, বিষয়টি পুলিশকে তারা জানিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই চাঁদাবাজির রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে ১০, ১৩ ও ২০ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতারা। এসব ওয়ার্ডের চিহ্নিত কতিপয় প্রভাবশালী নেতা প্রশাসনকে ম্যানেজ করার কথা বলে হকারদেরকে চাঁদা দিতে বাধ্য করছে বলে বেশ কয়েকজন হকার অভিযোগ করেছেন। এদের হয়ে চাঁদা তুলছে চিহ্নিত লাইনম্যানরাই। বায়তুল মোকাররম মসজিদের স্বর্ণ মার্কেটের সামনের ফুটপাতের এক হকার বলেন, আগেও এই ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তুলতো চাঁটগাইয়া হারুন, এখনও সেই তোলে। চাঁদা না দিলে মাস্তান দিয়ে ভয়ভীতি দেখায় মারধর করে। গুলিস্তানের আরও দু’জন হকার জানান, চাঁদাবাজদের সাথে আছে ওয়ার্কার্স পার্টি মহানগরের এক শীর্ষ নেতা এবং কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতাও। বিএনপি সমর্থিত বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার্স সমিতির নেতা কামাল সিদ্দিকীর সাথে আছে বিএনপির নেতারাও। এ ছাড়া মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে হলিডে মার্কেটের নামে প্রতিদিনই ফুটপাত দখল করে রেখে চাঁদাবাজি করছে সাইফুল মোল্লা। তার সাথে আছে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক এক সহ-সভাপতি। এখানকার হকাররা জানায়, চাঁদাবাজির জন্য এই নেতা একটি সমিতি গঠন করেছে। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল মোল্লা। আওয়ামী লীগের ওই নেতার জোরে মামলা হওয়ার পরেও সাইফুল মোল্লা চাঁদাবাজি করেছে জানিয়ে এক হকার বলেন, তার খুঁটির জোর আছে বলেই পুলিশ তাকে ধরে না। হকাররা জানায়, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সাইফুল মোল্লা মতিঝিল থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে রেখেছে। প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করলেও পুলিশ বরাবরই তাকে খুঁজে পায় না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুলিস্তানের ৩০টি ফুটপাতে আগেও ৩০ জন লাইনম্যান চাঁদা তুলতো। প্রতিটি লাইনম্যানের আবার একজন করে সহকারী আছে। লাইনম্যান ও তাদের সহকারী মিলে ৬০ জনের আবার একজন নেতা, একজন ক্যাশিয়ার ও একজন সহকারী আছে। ৬০ জনের এই নেতার নাম বাবুল। ক্যাশিয়ার দুলাল এবং তাদের সহকারীর নাম আমীন। ৬৩ জনের এই সিন্ডিকেটকে রক্ষার জন্য রাজনৈতিকভাবে সরকার সমর্থক একটি সংগঠনও বানানো হয়েছিল। যার সভাপতি ছিলেন আবুল হাশেম কবীর। এরা বরাবরই ফুটপাত উচ্ছেদের বিপক্ষে ছিল। একজন হকার বলেন, দিন শেষে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে এরা অভ্যস্ত। তাই ফুটপাতের মায়া ছাড়তে পারে না। গুলিস্তান, মতিঝিলসহ আশপাশের এলাকায় ফুটপাতের চাঁদাবাজদের তালিকা করে মামলাও করেছিল ডিএসসিসি। ওই তালিকায় যাদের নাম আছে তারা হলো, আমীর হোসেন, ভোলা, কানা সিরাজ, লম্বা হারুন, হারুনের শ্যালক দেলোয়ার, খোরশেদ, হাসান, হিন্দু বাবুল, রব, সুলতান, লিপু, মনির, তরিক আলী, আখতার, জাহাঙ্গীর, কালা নবী, সর্দার ছালাম, শহীদ, দাড়িওয়ালা সালাম, আলী মিয়া, কাদের, খলিল, কোটন, জাহাঙ্গীর, নসু, তমিজ উদ্দিন, বাবুল ভূঁইয়া, সাজু, কবির হোসেন, সাইফুল মোল্লা, ঘাউরা বাবুল ও বিমল। মামলার পরেও এসব হকারদের বেশিরভাগই ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অন্যদিকে, রাজধানীর তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। দেড় বছর আগে এই ট্রাক স্ট্যান্ড উদ্ধার করতে গিয়ে শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়েছিলেন উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। দিনভর সংঘর্ষ আর উত্তেজনার মধ্যে মেয়র সেদিন আপোষ করেননি। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তিনি ভুলতে না ভুলতেই আবারও দখল হয়ে যাচ্ছে পুরো এলাকা। সরেজমিনে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মূল সড়কে সারি করে ট্রাাক, লরি ও পিক আপ ভ্যান রাখা হয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হলে সাময়িকভাবে সরিয়ে নেয়া হয় সেগুলো। তবে কিছুক্ষণ পরে আবারও আগের দৃশ্যে ফিরে আসে এলাকাটি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিকেলে থেকেই বাড়তে থাকে মালামাল পরিবহনের এ গাড়িগুলো। আর সন্ধ্যার পর যেন আবারও সেই অবৈধ দখলের রাজত্ব। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রুস্তম আলী খান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, ট্রাক স্ট্যান্ডের ভিতরে কাজ চলছে। এ কারণে বাইরে কিছু কিছু ট্রাক রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভিতরের কাজ শেষ হলে বাইরে কাউকে ট্রক বা কাভার্ডভ্যান রাখতে দেয়া হবে না। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এতো ট্রাক কোথা থেকে আসে বুঝি না। তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড কখনওই দখল করতে দেয়া হবে না জানিয়ে রুস্তম আলী বলেন, আমরা এটা হতে দেবো না। আমাদের মেয়র সাহেবও এটা হতে দিবেন না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন