শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা এবং দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি

| প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ডিভ্যাল্যুয়েশন করেনি। তারপরেও দেখা যাচ্ছে, গত তিন দিনে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৭৮ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে ৮৫ টাকায় পৌঁছেছে। এই ৩-৪ দিনে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৬ টাকা ২৫ পয়সা বেড়েছে। এক সপ্তাহেরও কম সময়ে টাকার এত বড় অবমূল্যায়নের ঘটনা সাম্প্রতিক কালে আর ঘটেনি। এই ধরনের ঘটনা তখনই ঘটে যখন রফতানিতে ধস নামে। তখন রফতানি বৃদ্ধির জন্য টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়। অথচ এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি। গতকাল বৃহস্পতিবার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রæপ গত ফেব্রæয়ারিতে ১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার মূল্যের ছোলা আমদানির জন্য বিলম্ব ঋণপত্র (ডেফার্ড এলসি) খোলে। গত ২৬ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে ছোলা বোঝাই জাহাজটি ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের নৌসীমায় পৌঁছায়। এখন জাহাজ থেকে ছোলা খালাস চলছে। খালাস শেষ হওয়ার পর ডলার কিনে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে হবে। আলোচ্য গ্রæপের চেয়ারম্যান আবুল বাসার চৌধুরী বলেন, আমাদের এক চালানেই ৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা বেশি বিল পরিশোধ করতে হবে। ছোলা আমদানিতে কেজিপ্রতি ৪ টাকা বেশি খরচ পড়ছে। গম আমদানিতে কেজিপ্রতি এক থেকে দেড় টাকা বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। রোজা আসন্ন। বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে। সরবরাহ ব্যবস্থাও ভালো ছিল। কিন্তু দেশের মধ্যে ডলারের দাম হঠাৎ করে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় আগামী রোজার বাজার নিয়ে এখন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বন্দরে আসা সব ধরনের পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর অবধারিত পরিণতিতে যা ঘটবার তাই ঘটেছে। অপর একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় তিন কলামব্যাপী শিরোনাম দিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদটির শিরোনাম, ‘ছোলার দাম ৫ দিনেই বাড়লো মণপ্রতি ৬৫০ টাকা’। ঐ খবরে বলা হয়েছে, রমজান শুরুর প্রায় এক মাস বাকি। এরই মধ্যে ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ ছোলার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পর্যাপ্ত ছোলা আমদানির পরও গত পাঁচদিনে মণপ্রতি বেড়েছে ৬৫০ টাকা। দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গত ২২ এপ্রিল অস্ট্রেলিয়া থেকে আামদানিকৃত প্রতিমণ ছোলা ৩ হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ পাঁচ দিন আগে গত ১৭ এপ্রিল একই মানের ছোলা প্রতিমণ ২ হাজার ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। সে হিসাবে মাত্র পাঁচ দিনেই পণ্যটির দাম মণপ্রতি বেড়েছে ৬৫০ টাকা। আর কেজি ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়।
আলোচ্য পত্রিকায় ছোলার এই আকস্মিক মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসাবে যদিও ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু দৈনিক ‘ইনকিলাব’ গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান সংবাদে এই মূল্য বৃদ্ধিকে মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। ইনকিলাবের ঐ রিপোর্টে এই অস্থিরতার জন্য যে ৫টি কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো, প্রবাসী আয় হ্রাস, রফতানি আয়ে শ্লথ গতি, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, অফশোর ব্যাংকিংয়ের ঋণ ও বড় প্রকল্পের আমদানি ব্যয় পরিশোধের কারণে সম্প্রতি অস্থির হয়ে পড়েছে মুদ্রাবাজার। বিদেশী মুদ্রাগুলোর বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা টাকার মান হঠাৎ ব্যাপক হারে পড়ে গেছে। ইনকিলাবের ঐ রিপোর্টে বাংলাদেশ ব্যাংককেও দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকা সত্তে¡ও বাজারে ডলার ছাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই আচরণে ব্যবসায়ী মহল এবং ক্রেতা সাধারণ সকলেই খুব ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের একমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক নয়। তাদের উদ্দেশ্য মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং জনসাধারণের সেবা করা। কেন তারা বাজারে ডলার ছাড়ছে না সেটি জনসাধারণের বোধগম্য নয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন যে, এই সময়ে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। তিনিও স্বীকার করেছেন, ডলারের দাম বাড়লে পণ্যমূল্যের দামও বাড়বে। বাণিজ্যমন্ত্রী এই কথা বলার আগেই পণ্যমূল্য হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। এই সব ঘটনা এমন সময় ঘটলো যখন পবিত্র রমজান শুরু হতে আর মাস খানেক বাকি। রমজানে এমনিতেই পণ্যমূল্য কিছুটা বাড়ে। কিন্তু এখন হঠাৎ করে এই ডলারের দাম ৬ টাকা বৃদ্ধির ফলে প্রায় প্রতিটি পণ্যের, বিশেষ করে ইফতার সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পাবে। ইফতারের প্রধান সামগ্রীই হলো ছোলা, শরবত, খেজুর। এ সব পণ্যসহ আমদানিযোগ্য ইফতার সামগ্রীর দাম রোজাদারদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি আশা করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক শিগগিরই এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যার ফলে ডলারের মূল্য স্থিতিশীল হয় এবং পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। তবে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বাজারে কোন পণ্যের মূল্য একবার বৃদ্ধি পেলে সেটি আর কমে না। বাংলাদেশের ৪৬ বছরের ইতিহাসে দ্রব্যমূল্য কমার কোন উদাহরণ নেই। বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা যদি ঠিক হয় তাহলে ডলারের বিনিময় মূল্য হয়তো কিছুটা কমবে। কিন্তু রোজাদারদের বাড়তি খরচ আর কমবে না। বাজারে কোন রকম তদারকি নেই। যার যে রকম ইচ্ছা পণ্যমূল্য বাড়িয়েই চলেছে। রমজানের এখনও এক মাস দেরি আছে। এই সময়ে সরকার যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ তথা অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফাখোরী কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলে সাধারণভাবে জনগণ এবং বিশেষভাবে রোজাদারগণ পণ্যমূল্য বৃদ্ধির গুরুভার থেকে কিছুটা হলেও নিষ্কৃতি পাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন