গত মাসের মাঝামাঝিতে ঢাকায় এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন) কার্ড জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে দেশের ৯৫ লাখ এটিএম গ্রাহক বড় ধরনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন। এটিএম কার্ডধারী ব্যাংক গ্রাহকদের সবার হালনাগাদ তথ্য জানা এখনো সম্ভব না হলেও ইতিমধ্যে গ্রাহকদের একাউন্ট থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট হওয়ার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং সেক্টর যখন ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করতে শুরু করেছে, ঠিক তখন বাংলাদেশের এটিএম কার্ডধারী শত শত গ্রাহকের একাউন্ট হ্যাক্ড হওয়ার উদ্বেগজনক ঘটনা সংঘটিত হল। এটি আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত এবং জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের আঘাত। এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনা কোন বিষয় নয়। ব্যাংকিং সেক্টরের ডিজিটালাইজেশন এবং এটিএম ব্যবস্থা প্রবর্তনের শুরু থেকে পশ্চিমাবিশ্বেও এটিএম কার্ড জালিয়াতি বা ক্লোনিং ও হ্যাকিং-এর ঘটনা ঘটছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কোথাও একসাথে এমন সংঘবদ্ধ ও বিস্তৃত এটিএম জালিয়াতির ঘটনা ঘটেনি। বিশেষত: আমাদের মত দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের উদীয়মান অর্থনীতিতে এ ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে লাখ লাখ এটিএম গ্রাহকের ঝুঁকি ও আতঙ্কের মধ্যে পতিত হওয়া অনেক বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি। খুব দ্রুত প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়ে গ্রাহকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশের ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
বাংলাদেশে এটিএম বুথে কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গোচরে আসতে অনেক বেশী দেরী হওয়ায় বেশী সংখ্যক গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে অনুমান করা যায়। সংঘবদ্ধ কার্ড জালিয়াতচক্র দীর্ঘদিন নির্বিঘেœ জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেও সন্দেহের বাইরে থাকতে সক্ষম হওয়ায় তাদের নেটওয়ার্ক ক্রমে বিস্তৃত হয়েছে। সাম্প্রতিক তদন্তে এই চক্রের সাথে বিভিন্ন দেশের নাগরিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকিং সেক্টরের কিছু অসাধু ব্যক্তি, পুলিশ এবং রাজনীতির রাঘব-বোয়ালদেরও জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে আসছে। আটক হওয়া কথিত জার্মান নাগরিক পিওটরসহ দেশি-বিদেশি জালিয়াতচক্রের সাথে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তার যোগসাজশের আলামত পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকের কার্ড বিভাগের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সমাজের প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ থাকায় এটিএম কার্ড জালিয়াতির নিরাপদ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ঢাকা। গতকাল প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, বিদেশে থাকা গ্রাহকদের কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে ঢাকায় টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বিদেশি নাগরিকদের সাথে সন্দেহভাজন হিসেবে সিটি ব্যাংকের কয়েকজনকে আটক করা হলেও এটিএম কার্ড জালিয়াত চক্রের অধিকাংশ সদস্যই এখনো অধরা রয়েছে।
এমনিতেই সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে সরকারী মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ায় দেশের ব্যাংকিং সেক্টর এক ধরনের অনাস্থার সংকটে পতিত হয়েছে। খোদ অর্থমন্ত্রীকেও সরকারী ব্যাংক ‘ডাকাতি’ ও লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখা গেছে। দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকসহ সরকারী ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পরও দেশের কিছুসংখ্যক বেসরকারী ব্যাংক গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখার পাশাপাশি লেনদেনে গতিশীলতা ধরে অব্যাহত রেখেছে। বিশেষত: এটিএম কার্ড এবং ডিজিটাল ক্যাশ ট্রান্সফার ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ খাতে এখন বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এটিএম বুথে কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের নিরাপত্তা ও নজরদারি ব্যবস্থায় বড় ধরনের ত্রুটি ও দুর্বলতা ধরা পড়ল। এর পেছনেও রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং নিজস্ব নিয়মনীতি ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে তাদের অদক্ষতা বা অক্ষমতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান আর্থিক খাতের ডিজিটাল ব্যাবস্থায় ঝুঁকি বাড়ার কথা বলছেন। তবে এ খাতকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা মানতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করতে তারা যথাযথ উদ্যোগ না নেয়ার দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এড়াতে পারে না। প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা পিএসডি সার্কুলার নম্বর ০৩/২০১৩ নির্দেশনা ব্যাংকগুলো পালন না করায় এটিএম জালিয়াতি সম্ভব হয়েছে। অতীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন অনেক নির্দেশনাই বেসরকারী ব্যাংকগুলো গ্রাহ্য করেনি। নির্দেশনা পালন না করায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকর ব্যবস্থাও গৃহিত হয়নি। এবার এটিএম জালিয়াতি ঠেকাতে একমাসের মধ্যে সকল এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস স্থাপনের নির্দেশনার জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি প্রচলিত এটিএম কার্ডের স্থলে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ মাইক্রোচিপসংযুক্ত এটিএম কার্ড প্রবর্তনেরও উদ্যোগ নিতে হবে। আর এটিএম কার্ড জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত এবং অধরা রাঘব-বোয়ালদের ধরে দৃষ্টন্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের স্বার্থেই অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঝুঁকিমুক্ত রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন