শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রাজনীতিকরা অনাদরে, নূর হোসেনরা জামাই আদরে

প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায় যে, নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেন, র‌্যাব কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানাসহ অন্যান্য আসামী কেউ জেলখানা আবার কেউ অসুস্থতার সনদ নিয়ে হাসপাতালে জামাই আদরে অবস্থান করছেন। এই লোমহর্ষক হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত আসামীদের সাথে এই জামাই আদরের আপ্যায়ন দেখে নারায়ণগঞ্জবাসী হতবাক। গত সোমবার ২৯ ফেব্রুয়ারী এই মামলার ৩৫ জন আসামীর মধ্যে প্রধান আসামীসহ ২৩ জনকে আদালতে হাজির করা হয়। এদিকে বিচার কাজ শুরুর আগে আদালতের এজলাস থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ায় গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এই খবরের পাশাপাশি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত আরো দু’টি খবর সচেতন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারী একটি বাংলা জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম, ‘নূর হোসেনের প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে/এক মামলায় অব্যাহতি, একটিতে আপস, তিনটিতে জামিন’। উক্ত সংবাদে নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলামের আইনজীবী শাখাওয়াত হোসেনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, সাত খুনের মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেন ভারত থেকে দেশে আসার পরে পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো থেকে তিনি অব্যাহতি পেতে শুরু করেছেন। এ  অবস্থায় সাত খুনের মামলার বাদী আদৌ ন্যায়বিচার পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয় যে, ওইদিন আদালতে নূর হোসেন ছাড়া র‌্যাবের সাবেক অধিনায়ক তারেক  সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (অব্যাহতি) এম এম রানা ও নূর হোসেনসহ গ্রেপ্তার হওয়া ২৩ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। ওই রিপোর্টেই বলা হয়েছে,  আসামী নূর হোসেন আদালতে হাজিরা দিতে আসার আগে থেকেই কোন রাস্তা দিয়ে আসবে সেটি তার লোকজন জেনে যায় এবং তারা নূর হোসেনকে বহনকারী গাড়ীটি প্রটেকশন দিয়ে নিয়ে আসে। আদালতে অভূতপূর্ব নিরাপত্তা কড়াকড়ি থাকলেও নূর হোসেন এবং তার সহযোগী র‌্যাবের অফিসাররা বাইরের লোকজনদের সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলেন। নারায়ণগঞ্জ আদালতের অনেকেই বলেছেন, নূর হোসেনের আইনজীবী খোকন সাহা নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আবার মেজর আরিফের আইনজীবী আবদুর রশিদ আড়াইহাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অন্য আইনজীবীরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে আদালত পাড়ায় সাত খুনের মামলায় কী ঘটে, তা নিয়ে ঔৎসুক্য আছে।
আলোচ্য জাতীয় দৈনিকটিতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত আরেকটি খবর সুধিজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ওই খবরের শিরোনাম, ‘ইস্কাটনে জোড়া খুন/হাসপাতালে আয়েশেই আছেন সাংসদ পুত্র’। খবরে বলা হয়েছে যে, ইস্কাটনে জোড়া খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত জাতীয় সংসদ সদস্য পিনু খানের পুত্র বখতিয়ার আলম রনি চিকিৎসার নাম করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভি.আই.পি ক্যাবিনে খোশ মেজাজেই আছেন। তিনি হাসপাতালের কর্মীদের সাথে খোশগল্প করে সময় কাটাচ্ছেন এবং বলে বেড়াচ্ছেন যে, শীঘ্রই তার জামিন হবে। পত্রিকাটির রিপোর্টে বলা হয়, বখতিয়ার কেবিনে জামাই-আদরেই আছেন। চাইলে কেবিনের সামনে বিনা বাধায় ঘুরে বেড়ান। হাসপাতালের খাবার তিনি খান না। তাঁর জন্য বাসা থেকে খাবার আসে। প্রায় সারা দিনই তার কেবিনে লোকজন আসে। কর্তব্যরত কারারক্ষী আবদুর রহমান জানান, ‘ওনার পাহারায় সার্বক্ষণিক দু’জন কারারক্ষী থাকেন’। কারা সূত্র জানায়, বখতিয়ার কারাগারে ডিভিশনভোগী আসামী। গত ৩১ জানুয়ারী তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকে তিনি সেখানেই আছেন। হাসপাতাল ও কারা সূত্র মতে, এর আগেও বখতিয়ার অসুস্থতার কথা বলে চার দফায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রিজন সেলে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসকরা তাঁর কোনো রোগ খুঁজে পাননি। এই বখতিয়ার আলম নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গত বছরের ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে প্রাডো গাড়ি থেকে তার পিস্তল দিয়ে চার-পাঁচটি গুলি ছোঁড়েন। এতে রিকশা চালক আবদুল হাকিম ও দৈনিক জনকণ্ঠের অটোরিকশা চালক ইয়াকুব আলী আহত হন। হাকিম ১৫ এপ্রিল ও ইয়াকুব ২৩ এপ্রিল মারা যান। এ ঘটনায় হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম ১৫ এপ্রিল রাতে রমনা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
গত বৃহস্পতিবার দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রধান বিচারপতির একটি সংবাদ বোদ্ধা মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গতকাল সিলেট জজ কোর্ট প্রাঙ্গণে ‘ডিজিটালাইজড উইটনেস ডিপোজিশন সিস্টেম’এর উদ্বোধন কালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, দেশে গণতন্ত্র কিছু সুবিধা ভোগী মহলের কাছে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদদের সহযোগিতা ছাড়া চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধা করা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সবার আগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বলা বাহুল্য, নূর হোসেন এবং এমপি পুত্র রনির জামাই আদরের পাশাপাশি যখন দেখা যায় যে, দেশে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদদের ডিভিশন দেওয়া হচ্ছে না, দিনের পর দিন তাদের কারাগারের মেঝেতে শুয়ে থাকতে হচ্ছে, যখন বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও ওসব সম্মানিত রাজনীতিবিদের পিজি হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হচ্ছে না, তখন আইনের শাসন অথবা গণতন্ত্রের সার্বজনীন সুবিধার অনুপস্থিতি প্রকট হয়ে দেখা যায়। নূর হোসেনকে যখন পশ্চিমবঙ্গের জেল থেকে বের করে এনে যশোরের বেনাপোলে র‌্যাবের গাড়িতে তোলা হয় তখন এক ভয়ার্ত নূর হোসেন র‌্যাবের ওই অফিসারকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “স্যার, আমাকে কী ক্রসফায়ারে নেওয়া হবে?”  সেই নূর হোসেনকে আজ জেলখানায় হাতকড়াও পরতে হয় না, তার ভাগ্যে জোটে পোলো শার্ট। কোন মাপকাঠিতে তিনি ভিআইপি মর্যাদা পান, কোন মাপকাঠিতে এমপি পুত্র এবং রিকশাওয়ালা ও সিএনজিওয়ালাকে গুলী বর্ষণকারী রনি ভিআইপি মর্যাদা পায়, আর এক শ্রেণীর পলিটিশিয়ানরা দিনের পর দিন মাসের পর মাস জেলখানায় বিনা চিকিৎসায় মানবেতর জীবন কাটান, সেটি কোনো শিক্ষিত মানুষের বোধগম্য হয় না। আইনের শাসন থাকলে এই অন্যায়,উৎকট এবং বৈষম্যমূলক আচরণ হতে পারতো না। এসব অন্যায় ও অবিচারেরর আশু অবসান ঘটবে বলে শিক্ষিত-সচেতন মানুষ আশা করে। 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন