বিগত দেড় দশকের বেশি সময় পর এ বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার পাসের হার কমেছে। ২০০১ সালে পাসের গড় হার ছিল ৩৫.২২ শতাংশ। এই হার বাড়তে বাড়তে ৯১.৩৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠে। শিক্ষাবিদদের অভিযোগ ছিল, উদারভাবে খাতা মূল্যায়নের নির্দেশের মাধ্যমে পাসের হার বাড়িয়ে সংশ্লিষ্টদের কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টা ছিল। এ নিয়ে কম আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। বেশিরভাগ শিক্ষাবিদদের মত, পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার মান কমে গেছে। এতে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় এক নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে এসএসসির ফলাফল প্রকাশের পরপরই এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য এ অভিযোগ বরাবরই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বোর্ডগুলোর পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে। এ অভিযোগের মধ্যেই এ বছর এসএসসির পাসের হার কমে গেছে। দশ বোর্ড মিলিয়ে পাসের গড় হার ৮০.৩৫ শতাংশ। গত বছর ছিল ৮৮.২৯ শতাংশ। পাসের হার কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি ও একটি নীতিমাল করে দেয়া। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে কোনো পদ্ধতি ছিল না। শত শত বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে। আমাদের খাতা দেখা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এবার একটা মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করেছি। পরীক্ষকদের খাতার সঙ্গে মডেল উত্তরও দেয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী খাতা মূল্যায়নের নির্দেশনা দেয়া হয়। এছাড়া এতদিন প্রধান পরীক্ষকরা খাতা না দেখেই মতামত দিতেন। এবার প্রধান পরীক্ষককেও ১২ শতাংশ খাতা দেখতে হয়েছে। শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, দেরিতে হলেও পাসের হার বৃদ্ধি দেখানোর প্রবণতা থেকে বের হয়ে খাতার যথাযথ মূল্যায়ন করে ফলাফল প্রকাশ করা ইতিবাচক। এতে কিছুটা হলেও শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বিগত বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে পাশের হারের যে উলম্ফন, তা যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বোর্ডগুলোর মধ্যে পাসের হার বৃদ্ধি দেখিয়ে এক ধরনের কৃতিত্ব নেয়ার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠে। খাতা দেখার ক্ষেত্রে উদার নীতি অবলম্বন এমনকি কাউকে ফেল করানো যাবে না-এমন একটি অলিখিত নির্দেশনা ছিল বলে অভিযোগ উঠে। এর ফলে পাশের হার প্রতি বছরই হু হু করে বেড়েছে। প্রতি বছরই মেধার বিস্ফোরণ ঘটেছে। অন্যদিকে দেশের সচেতন শ্রেণী ও শিক্ষাবিদরা একে শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে অশনি সংকেত হিসেবে গণ্য করেছেন। দেখা গেছে, যেসব শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ পেয়েছে, ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাদের অধিকাংশই ঝরে পড়েছে। অথচ স্বাভাবিক বিবেচনায় এসব মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। সাধারণ ফলাফল নিয়ে যেসব শিক্ষার্থী পাস করেছে, ভাল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি সোনার হরিণ হয়ে পড়ে। এ থেকে শিক্ষার মান এবং পাশের হার বৃদ্ধির বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শিক্ষাব্যবস্থায় অসুস্থ পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি হয়। শিক্ষা সার্টিফিকেট সর্বস্ব হয়ে পড়ে। সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষার্থী যেমন নিজে ব্যর্থ ও হতাশ হয়, তেমনি তারা ধীরে ধীরে দেশের বোঝায়ও পরিণত হয়। শিক্ষাবিদরা বারবারই বলেছেন, উদার খাতা মূল্যায়ন এবং কাউকেই ফেল করানো যাবে না-এমন নীতি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন। তা নাহলে দেশ একদিকে যেমন মেধাশূন্যতার দিকে যাবে, অন্যদিকে হতাশ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, একজন সত্যিকারের মেধাবী শিক্ষার্থীর পাশাপাশি কম মেধাবী শিক্ষার্থীকেও সমান ফলাফল করতে দেখা গেছে। এতে সংগতকারণেই মেধাবী শিক্ষার্থীর মধ্যে হতাশা দেখা দেয়া স্বাভাবিক। বিলম্বে হলেও শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি উপলব্ধি করেছে। তারা বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দেয়ায় এবারের ফলাফল কিছুটা হলেও শিক্ষার মান উত্তরণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পদক্ষেপ হয়ে থাকবে। পরীক্ষার খাতা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করলে যে সত্যিকারের মেধার বিচার হয়, তা পরিলক্ষিত হয়েছে। দেখা গেছে, এবার সারা দেশের ৯৩টি প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি। গত বছর এ সংখ্যাটি ছিল ৫৩। জিপিএ-৫ এর সংখ্যাও কমেছে। এই ফলাফল বিগত বছরগুলোর তুলনায় কম হলেও এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও মেধাভিত্তিক ফলাফলের চিত্র ফুটে উঠেছে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানগুলো শূন্য ফলাফল করেছে, সেগুলোকে ভাল করার সুযোগ সরকারকে দিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের সমস্যা চিহ্নিত করে তা নিরসনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এবারের ফলাফলে বরাবরের মতোই গ্রাম ও শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাসের হারের মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা গেছে। অথচ সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যদি তাদের অধিকাংশই ভাল ফলাফল করতে না পারে, তবে তার কুফলও অনিবার্যভাবে পড়বে। শহর ও গ্রামের শিক্ষার মানের এই ব্যবধান কমিয়ে আনার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া অপরিহার্য। তা নাহলে সার্বিক শিক্ষার মান নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এবার যে নীতির মাধ্যমে খাতা দেখা হয়েছে, তা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। আমরা চাই, সব শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করুক। তবে তা যোগ্যতার মাধ্যমে করুক। যার জিপিএ ৫ পাওয়ার যোগ্যতা নেই, তাকে তা দিয়ে দেয়া হলে, তার জন্য যেমন ক্ষতিকর, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যও ক্ষতিকর। আশার কথা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে আগামীতে শিক্ষার মান বৃদ্ধি ঘটবে। এ কথাও বলা আবশ্যক, শিক্ষার মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষ শিক্ষক প্রয়োজন। শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। তা নাহেল, খাতার মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে যেমন গলদ থেকে যাবে, তেমনি মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যও অনর্জিত থেকে যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন