মিজানুর রহমান তোতা : জীবদ্দশায় দুই এক শতক জমির অভাবে বিশাল জনগোষ্ঠীর একটু মাথা গোজার ঠাঁই মেলে না। বিশেষ করে গরীব, অসহায় ও দুঃস্থদের নিজের বাড়ীতে থাকার স্বপ্ন কখনোই পুরণ হয় না। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নগর ও শহরে যেখানে এক শতক জমির মূল্য ৮/১০ লাখ টাকার কম নয়। কোথাও কোথাও এর চেয়েও বেশী। সেখানে শুধুমাত্র দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেই বছরের পর বছরের অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে সরকারের হাজার হাজার টাকার সম্পত্তি। অথচ সরকারি নির্দেশনায় এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে এর কার্যকারিতা নেই। ব্যক্তিগত সম্পত্তি সাধারণত কেউ অব্যবহৃত রাখে না। কিন্তু সরকারি সম্পত্তির ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটে আসছে যুগ যুগ। সরকারি অনেক জমি ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’-অবস্থায় রয়েছে। আবার সরকারি সম্পত্তি যে যার মতো ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দখল করে নিজের সম্পত্তির মতো ভোগদখল করছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে,দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বেদখলে চলে গেছে সরকারের হাজার হাজার টাকার সম্পত্তি। আবার বিপুল পরিমাণ মূল্যবান সম্পত্তি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ইতোমধ্যে পুরোপুরি বেহাত হয়ে যাওয়া সম্পত্তির পরিমাণও কম নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর কর্মকর্তাদের দায়িত্ববোধের অভাবই সরকারি সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের বড় অন্তরায়। জেলা পরিষদ, রেলওয়ে এবং সড়ক ও জনপথসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের বিশাল বিশাল এলাকার জায়গাজমি পড়ে আছে। রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য বিল-বাওড়। কোথা নাম কা ওয়াস্তে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দেয়ার নামে লিজ দেয়া হয়েছে। কোথাও স্থানীয় প্রভাবশালীরা যে যার মতো জবরদখল করে ভোগ করছে। কোথাও ভূমিহীনদের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিত্তশালীদের। একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও এর থেকে পিছিয়ে নেই। তারা সুযোগমতো নিজের কিংবা স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের এমনকি দুরসম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনের নামে অনেকটা স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যশোর, খুলনা, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোন এলাকায় কত একর সরকারি জমি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে তার কোন তথ্য দিতে পারেনি খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তর, যশোর জোনাল সেটেলমেন্ট অফিস, রেলওয়ে, সড়ক, জেলা পরিষদ ও ভূমি অফিসসহ সংশিষ্ট বিভাগগুলো। সংশিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য গোটা অঞ্চলের অব্যবহৃত জমির পরিমাণ একত্রে করে সঠিক তথ্য দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, বিভিন্নস্থানে তা চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, সরকারি সম্পত্তি দখলদারদের সিংহভাগই বিত্তশালী। সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারের নামে মাঝেমধ্যে স্থানীয়ভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে অভিযান চললেও বস্তিবাসীদের উপরই আঘাতটা পড়ে বেশী। অভিযানের ছোঁয়া লাগে না প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের। এসবক্ষেত্রে নিঁখুতভাবে খোঁজ নিলে সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় সরকারি কর্মকর্তাদের গাফিলতির পুঙ্খানুপঙ্খ বিবরণ পাওয়া যাবে, যাতে যে কোন সচেতন ও বিবেকবান মানুষ হতবাক হবেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্রে জানা গেছে, যশোর, খুলনা ও কুষ্টিয়াসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলায় প্রতিবছর গড়ে কৃষি থেকে অকৃষিতে চলে যাওয়া জমির পরিমাণ গড়ে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর। এ অঞ্চলে মোট জমি ২১ লাখ ১১ হাজার ৬৬ হেক্টর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১২লাখ ৬হাজার ৫শ’৩০ হেক্টর। স্থায়ীভাবে পতিত রয়েছে ৫৬হাজার ৬৫৮ হেক্টর। এই পতিত জমিও আবাদের আওতায় আনা হচ্ছে না। বাকি জমি জলাশয়, বনভূমি, রাস্তাঘাট, রেলওয়ে, বাড়ীঘর, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, ফল বাগান ও শহরাঞ্চল। এর মধ্যে সরকারি সম্পত্তির কোন হিসাবের সমন্বয় নেই এক দপ্তরের সাথে আরেক দপ্তরের।
যশোর ও খুলনার ভৈরব নদপাড়, কুষ্টিয়ার পদ্মাপাড়, জিকের অব্যবহৃত ক্যানেল, নড়াইলের মধুমতি নদীপাড়, ঝিনাইদহ ও মাগুরার নবগঙ্গা নদীপাড়, যশোর পুলেরহাট, উপশহর, বারান্দীপাড়া, খুলনা থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত বিভিন্নস্থানে রেলওয়ের জমি এবং গোটা অঞ্চলের সড়কের একাংশসহ গোটা অঞ্চলের হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি রয়েছে। এর একটা অংশ ভোগদখল হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানায়।
এ অঞ্চলের কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, কাগজ কলমে সরকারি সম্পত্তি অথচ বাস্তবে ব্যক্তিমালিকানায় রয়েছে অনেক জমি। খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তর, বিভিন্ন জেলার জোনাল সেটেলমেন্ট অফিস, রেলওয়ে, সড়ক, জেলা পরিষদ ও ভূমি অফিসসহ সংশিষ্ট বিভাগগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা পরিষদ, সড়ক ও রেলওয়ের সম্পত্তিই বেশী বেদখলে রয়েছে। বেহাত হয়ে গেছে এসব সরকারি বিভাগের জমি। এক বিভাগ আরেক বিভাগকে দোষারোপ করেই তারা দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যশোর জেলার গুরুত্বপুর্ণ ও পরিচিত একটি স্থানের নাম রাজারহাট পিকনিক কর্ণার ‘ক্ষণিকা’। যশোর-খুলনা মহাসড়কের গা ঘেষা বিশাল আয়তনের পিকনিক কর্ণারটি বহুবছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। গুরুত্বপুর্ণ স্থানটি ব্যবহার উপযোগী করার কোন উদ্যোগ নেই। পিকনিক কর্ণারটি ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত। ৫৬ বিঘা অর্থাৎ অর্ধ শতাধিক বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত রাজারহাট পিকনিক কর্ণার একসময় ছিল রমরমা। এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। মূল্যবান সরকারি সম্পত্তি প্রতিবছর ব্যবহার করা হলে বিপুল অংকের অর্থ আয় করার সুযোগ রয়েছে। অথচ কাজে লাগানো হচ্ছে না। গোটা অঞ্চলের বিভিন্নস্থানে এরকম বহু সরকারি সম্পত্তি অব্যবহৃত পড়ে আছে। বিষয়টির দিকে সরকার দৃষ্টি দিলে সরকারি সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহার ও বেদখলে যাওয়া সম্পত্তি উদ্ধার হত। এর ফলে, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে সচেতন ও পর্যবেক্ষক মহল থেকে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন