রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অবক্ষয় ও নিরাপত্তাহীনতার মহামারি

প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাম্প্রতিক অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ এখন চরম সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার কবলে পড়েছে। দেশের কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ধর্ষ অপরাধ ও বীভৎস হত্যাকা-ের ঘটনা। বিশেষভাবে হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে শিশুরা। সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পারিবারিক-সামাজিক বিরোধে শিশুদের টার্গেট করার এমন নজির অতীতে আর কখনো ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। সেইসাথে যুক্ত হয়েছে পেশাদার অপরাধের নতুন মাত্রা। দেশের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রায় সকল স্তরেই নিরাপত্তাহীনতা সর্বগ্রাসী প্রকৃতি গ্রহণ করেছে। সরকার যখন দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে অগ্রাহ্য করে তথাকথিত উন্নয়নের জিগির তুলে জাতিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা শোনাচ্ছে, তখন একদিকে সরকারি দলের প্রভাবশালী রাঘব বোয়ালদের দ্বারা সরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। অন্যদিকে ডিজিটাল ব্যাংকিং ও অর্থব্যবস্থার আড়ালে দেশের ব্যাংক গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট করে এই সেক্টরে চরম বিশৃঙ্খলা ও আস্থাহীনতার জন্ম দেয়া হচ্ছে। সরকারের প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ব্যাংকার, দেশি-বিদেশি পেশাদার সন্ত্রাসী-অপরাধী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর অপরাধী সদস্যের যোগসাজশে বাংলাদেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এখন চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ ও পন্থা দেখা যাচ্ছে না।
প্রায় প্রতিদিনের খবরের কাগজে উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর ও ভয়ঙ্কর হত্যাকা-সহ নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা। একের পর শিশুহত্যার ঘটনায় জাতি যখন উদ্বিঘœ ও আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে, তখন ঢাকার বনশ্রীতে নিহত দুই সহোদর ভাইবোনের হত্যাকা-ের সাথে তাদের গর্ভধারিণী মায়ের জড়িত থাকার বিস্ময়কর, অবিশ্বাস্য তথ্য দিয়েছে র‌্যাব। সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিক স্খলন কতটা অধঃগামী হলে শিশুরা এভাবে অনিরাপদ হয়ে পড়তে পারে, তা ভেবে আতঙ্কিত হতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ক্রমবর্ধমান হারে শিশুহত্যার ঘটনাকে সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক ট্রমা এবং সামাজিক-মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ও অসুস্থতার লক্ষণ বলে মনে করছেন। মানবসভ্যতার উন্মেষের কাল থেকেই মানুষ স্বভাবত সংঘবদ্ধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, হানাহানি ও একপাক্ষিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার পাশাপাশি বিরোধী দলকে রাজনৈতিক কর্মকা- পালনে বাধা দিতে ও বিরত রাখতে পুলিশ-র‌্যাবের মাত্রাতিরিক্তি বলপ্রয়োগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আটক, অপহরণসহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে যে সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া বা ফল এখন নানাভাবে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
পেশাদার খুনি, ইয়াবা ও মাদকের কারবারিদের সাথে একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যের যোগসাজশের অভিযোগ নতুন নয়। কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কোটি কোটি টাকার হাজার হাজার ইয়াবাসহ র‌্যাব-পুলিশের হাতে আটক হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। দীর্ঘদিনের অবাধ সিন্ডিকেশনের মধ্য দিয়ে দেশের মাদক চোরাকারবারিরা এখন কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তা গতকাল প্রকাশিত এক খবর থেকে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি মাদকবাহী ট্রাককে ধাওয়া করতে গিয়ে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে নির্মম পরিণতির শিকার হয়েছেন শিবগঞ্জ থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তা। গতকাল প্রকাশিত আরো কয়েকটি খবরের মধ্যে রয়েছে, নরসিংদিতে ৯ ঘণ্টায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ২ জন এবং পুলিশের গুলিতে ২ জনের নিহত হওয়ার খবর। গত কিছুদিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে দেশি-বিদেশি চক্রের কোটি কোটি টাকা লোপাট করার খবর প্রকাশিত হচ্ছিল। এবার জানা গেল গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একটি এটিএম বুথের নগদ প্রায় ২ কোটি টাকা অস্ত্রের মুখে ব্যাংক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তারক্ষীদের কাছ থেকে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে মাইক্রোবাস আরোহী সন্ত্রাসীরা। গতকাল প্রকাশিত আরেকটি খবরে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সেভেন মার্ডারের প্রধান আসামি নূর হোসেন এবং অভিযুক্ত সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিলেন। এর আগে বিভিন্ন সময়ে এই নির্মম হত্যাকা-ের র্চাজশিটভুক্ত আসামিরা কারাগারে জামাই আদরে বিলাসী জীবনযাপন করছেন বলে খবর বেরিয়েছে। যেখানে নিরপরাধ রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের অনেক অভিযোগ রয়েছে, সেখানে ঠা-া মাথায় খুনের আসামিদের রিমান্ডে না নিয়ে জামাই আদরে রাখার মধ্যেই আমাদের আইনের শাসনের ঘাটতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এই সর্বব্যাপী সামাজিক অবক্ষয় ও অস্থিরতা দূর করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের বেপরোয়া অপরাধ প্রবণতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করতে হবে। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি অস্ত্র, মাদক ও টাকা পাচারকারীদের কঠোর হাতে দমন করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাপক সামাজিক-রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমেই এই সামাজিক অসুস্থতার মহামারি থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে।   

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন