শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

উন্নয়ন দ্রুতায়িত করতে দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে

প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১০ এএম, ১০ মে, ২০১৭

দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অন্তত:১০ টি ফাস্ট ট্রাক মেগা প্রকল্প গ্রহন করেছিল। প্রথম দফায় ক্ষমতার ৫ বছর পেরিয়ে দ্বিতীয় দফায় আরো প্রায় সাড়ে তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও এসব প্রকল্পের কোনটিই বাস্তবায়নের মুখ দেখছেনা। কয়েক দফা সময় এবং বাজেট বাড়ানোর পর যাত্রাবাড়ি-গুলিস্তান ফ্লাইওভার চালু হলেও দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতির লাইফ লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প এখনো সম্পুর্ন না হওয়ায় তা থেকে কাঙ্খিত অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হচ্ছেনা। অন্যদিকে সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জভিত্তিক মেগাপ্রকল্প পদ্মাসেতু ২০১৮ সাল নাগাদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন যে গতিতে এর কাজ চলছে তাতে ২০২২ সালের আগে এই প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। রাজধানীবাসির জন্য স্বপ্ন জাগানিয়া আরেকটি মেগা উন্নয়ন প্রকল্প মেট্টোরেল প্রকল্পের কাজও চলছে অস্বাভাবিক ধীর গতিতে। এর মূল কাজ এখনো শুরুই হয়নি। একদিকে সংশ্লিষ্ট কন্ট্রাক্টর এবং সরকারের বাস্তবায়নকারি সংস্থাগুলো দক্ষতা ও কর্মসক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, অন্যেিদক এসব প্রকল্পের অর্থায়নের সাথে যুক্ত দেশগুলোও তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড়ের প্রশ্নে একধরনের অনীহা ও দীর্ঘসুত্রিতার আশ্রয় নিচ্ছে। এক্ষেত্রে চীন, ভারত, জাপানসহ উন্নয়ন সহযোগি দেশ ও সংস্থাগুলো যেন একই সমান্তরালে অবস্থান করছে।
সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রায় ১০ বছর সময় পাচ্ছে। গত মেয়াদের শেষদিকে বিরোধি জোটের কয়েক মাসের আন্দোলনের সময়টুকু বাদ দিলে বাকি পুরো সময়ই দেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদ্যমান ছিল এবং আছে। এখন সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের ট্রেনও যেন শ্লথ হয়ে পড়েছে। সেই সাথে অর্থনৈতিক খাতগুলোতেও নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থ বছরের প্রথম ৯ মাসে এনবিআর’র রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। হাওরাঞ্চল, চলনবিলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক অকাল বন্যায় ফসলহানি এবং পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক স্ফীতির কারনে অর্থবছরের বাকি ৩ মাসে  রাজস্ব ঘাটতি আরো বেড়ে যেতে পারে। প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, অর্থ বছরের এ সময়ে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বিগত অর্থ বছরের চেয়ে ৩২শতাংশ বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে যেখানে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪৭৯ কোটি ২০ লাখ ডলার, সেখানে চলতি অর্থবছরে এ সময়ে  তা’ ৭০৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারে উন্নীত হয়েছে। টাকার অঙ্কে তা’ ৬০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। এতদিন সরকারের পক্ষ থেকে ৭.১ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ফোরকাস্ট করা হলেও সর্বশেষ জাতিসংঘের এক জরিপ মূল্যায়নে তা ৬,৮ শতাংশেল বেশী হবেনা বলে জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে ২০১৮ সালে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো কমে ৬.৫ শতাংশে নেমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বৈদেশি কর্মসংস্থান, রেমিটেন্স প্রবাহ এবং তৈরী পোশাক খাতের রফতানী প্রবৃদ্ধিতেও নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় ক্ষমতার শেষ লগ্নে এসে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে সরকারকে সুচিন্তিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে।
দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা যেখানেই থাক, এই মুহুর্তে দক্ষিন এশিয়ার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনাময় মেরুকরণ ঘটে চলেছে। বিশেষত: বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে চীনের বিনিয়োগ প্রস্তাবসহ আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির উদ্যোগগুলোতে দ্রুত সাড়া দিতে হবে। দু:খজনক হলেও সত্য যে, চীন-ভারতের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ যেন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থায় পড়েছে। বাংলাদেশের সিদ্ধান্তহীনতা এবং ধীরে চলা নীতির কারণেই উন্নয়ন সহযোগিতা ও বিনিয়োগ প্রকল্প নিয়ে দ্বিধান্বিত ও শ্লথ হয়ে পড়েছে চীনের অর্থায়ন। এ ক্ষেত্রে সরকারের অতিমাত্রায় ভারত মুখাপেক্ষিতাকেই দায়ী করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। যেখানে ভারত নিজেই চীনের বিনিয়োগের মুখাপেক্ষি, সেখানে বাংলাদেশ চীনের সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ ও উন্নয়ন প্রস্তাবগুলো নিয়ে গড়িমসি করার কোন যুক্তি নেই। গত জানুয়ারীতে সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে প্রকাশিত ২০১৭ সালের আইডিআই (ইনক্লুসিভ গ্রোথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স) রিপোর্টে অর্থনৈতিক সাফল্যে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে ২৪ ধাপ এগিয়ে আছে বলে উল্লেখিত হয়েছিল। যেখানে ভারত নিজেই অর্থনৈতিক সাফল্যের দিক থেকে বাংলাদেশকে অতিক্রম করতে পারছেনা, সেখানে ভারতকে খুশি রাখতে চীনের  উন্নয়ন সহযোগিতা ও বিশাল বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে প্রলম্বিত করা বা দূরে ঠেলে দেয়া বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতি। গৃহিত মেগাপ্রকল্পসমুহ সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন না হলে এসব  উন্নয়ন প্রকল্প দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য ইতিবাচক ফলাফল দিতে ব্যর্থ হবে। দক্ষিন এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় চীনের প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ যুগান্তকারি মাইলফলক প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পূর্বমূখী যোগাযোগ অবকাঠামো এবং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’অর্থনৈতিক করিডোরে বাংলাদেশের সংযুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। কোন হীন রাজনৈতিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে জাতীয় দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থের নিরীখে সরকারকে এসব বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে। ভারতমুখিতা আমাদের উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে মোটেই সহায়ক হবেনা। সুতরাং নীতি নির্ধারনে ভারত নির্ভরতা পরিহার করে চীনের প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহায়তা প্রস্তাব কাজে লাগাতে সরকারকে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন