মধুমাস জ্যৈষ্ঠ চলছে। নানা জাতের আমসহ মৌসুমী ফলে ভরে উঠতে শুরু করেছে বাজার। তবে এসব বাহারি মওসুমি ফল সম্পর্কে সচেতন নাগরিক মহলে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। এ ভীতি অমূলক নয়, বেশী লাভের আশায় ফল পরিপক্ক হওয়ার অনেক আগেই প্রথমত: গাছে রাসায়নিক রাইপেন ব্যবহার করে এবং অপরিপক্ক আম, লিচু, কলা কার্বাইড দিয়ে পাকিয়ে বাজারজাত করছে এবং পচন থেকে রক্ষা করতে ফর্মালিন ব্যবহার করছে একশ্রেনীর মুনাফাবাজ ব্যবসায়ী। এসব আম ও ফল ফলারি বাহ্যিকভাবে দেখতে মনোহর হলেও এর স্বাভাবিক স্বাদ, গন্ধ থাকেনা। উপরন্তু অনেক দাম দিয়ে এসব ফল খেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে শিশু-বৃদ্ধসহ সব বয়েসের মানুষ। দেশের প্রায় দুইকোটি মানুষ কিডনী সমস্যায় আক্রান্ত। নানা ধরনের ক্যান্সার ও লিভারের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বছরে আরো কয়েক লাখ মানুষ। ব্যাপকহারে কোটি মানুষের এই স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ার জন্য খাদ্যে ভেজাল এবং রাসায়নিক মিশ্রিত ফল, মাছ-মাংসের মত ভোগ্য পণ্যকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। খাদ্যের ভেজাল থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যায় বছরে বৈদেশিক মূদ্রায় দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এ খাতে দেশে ব্যয়িত অর্থের পরিমান নি:সন্দেহে আরো অনেক বেশী। প্রকাশিত এক রিপোর্টে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের বরাত দিয়ে বলা হয়, সে হাসপাতালের রোগিদের অর্ধেকই বাংলাদেশের। এদের বেশীরভাগই কিডনি, লিভার ও প্রজণন সমস্যায় আক্রান্ত। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষনায় দেখা গেছে, ব্যাপকহারে কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য মূলত রাসায়নিক বিষযুক্ত খাদ্য দায়ী। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যের বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
রাস্তার পাশের ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেল-সুপারমলে দেশে উৎপাদিত অথবা আমদানীকৃত কোন ভোগ্যপন্যই নকল-ভেজাল ও রাসায়নিকের ঝুঁকিমুক্ত নয়। নামি-দামি হোঁটেল রেস্তোরার খাদ্যেও ভেজাল, বাসি-পঁচা ও অননুমোদিত রং ও রাসায়নিক ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায় ভেজাল বিরোধি ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে। তবে মওসুমি ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের মাত্রা কমিয়ে আনার উদ্যোগ যেন তেমন কোন কাজে আসছেনা। অধিক লাভের আশায় আম পরিপক্ক হওয়ার আগেই রাসায়নিক দিয়ে পাকিয়ে বাজারজাত করা রোধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে আম সংগ্রহের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল গত বছর। সরকারের বেঁধে দেয়া সেই সময়সীমাও বাস্তবসম্মত না হওয়ায় আম চাষিদের আর্থিক ক্ষতি অথবা সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যত্যয় দেখা গেছে। বিশেষত সময় বেধে দেয়ার কারনে আগে পেকে যাওয়া ফল বাজারজাত করতে না পারায় কৃষকের ক্ষতির কথাও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গত বছর ২৫ মে থেকে পর্যায়ক্রমে নানা জাতের আম সংগ্রহের সময় বেধে দেয়ার কারনে আগে পেকে যাওয়া ফল বিপণনে সমস্যা হওয়ায় এবার আম সংগ্রহের সময়সীমার কোন ধার ধারছেনা কৃষকরা। যে সব আম আরো একমাস পর বাজারে আসার কথা, সেই হিমসাগর, ক্ষিরসাপাতি লক্ষণভোগ জাতের আমও এখন বাজারে দেখা যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, এসব আমের বেশীরভাগই ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে পাকানো বিধায়, এর স্বাদ, গন্ধ ও মিষ্টতা খুঁজে পাচ্ছেনা ভোক্তারা। উপরন্তু এসব রাসায়নিক মিশ্রিত ফলের স্বাস্থ্যঝুঁকি তো আছেই।
শুধু আম নয়, ইতিমধ্যে নানা জাতের লিচুও বাজারে দেখা যাচ্ছে। গাছে থাকা ফলে রাইপেন এবং অপরিপক্ক আম, কলা, লিচু, টমাটোতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথোফেন, ইথ্রেল জাতীয় রাসায়নিক ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হলেও তা নিবৃত্ত করার কোন স্থায়ী তদারকি ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। অনিয়মিতভাবে, মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমান আদালতকে ভেজাল বিরোধি অভিযান পরিচালনা করতে দেখা গেলেও এসব অভিযানে বাজার পরিস্থিতিতে তেমন কোন পরিবর্তন আনতে পারছেনা। তা’ ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় ভেজাল ও রাসায়নিকমুক্ত খাদ্য বিরোধি অভিযান খুবই অপ্রতুল বা নগণ্য। ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথ্রেল, ইথোফেন, ফর্মালিনের মত রাসায়নিক আমদানী, বিপণন ও ব্যবহারের সুযোগ অবারিত রেখে মাঝে মাঝে ভেজাল বিরোধি অভিজান পরিচালনা করে ভেজালমুক্ত ফল ও খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। রাজশাহী ও চাপাই নবাবগঞ্জসহ বানিজ্যিক ফল বাগানগুলোতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের পক্ষ থেকে নিয়মিত পর্যবেক্ষন ও তদারকি জোরদার করতে হবে। শুধুমাত্র নাম-কা ওয়াস্তে ভেজাল বিরোধি অভিযান পরিচালনা করলেই হবেনা, কোটি কোটি মানুষের কিডনি, লিভার, ক্যান্সার ও হৃদরোগের জন্য দায়ী ভেজাল খাদ্য ও ফলমূলে রাসায়নিক মিশ্রনের সাথে জড়িতদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রকৃতির অপার দান মওসুমি ফলমূল ও শাক-সব্জির স্বাস্থ্যসম্মত মান নিশ্চিত করতে সরকারকে আরো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন