মো. তৌহিদুল ইসলাম
ঢাকার জিনজিরায় গার্মেন্ট ব্যবসায়ী এম এইচ হোসেনের স্ত্রী নাসরিন আক্তার কেক, পেস্ট্রিসহ কনফেকশনারি সামগ্রী তৈরি করে নিয়মিত বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করেন। এতে তার মাসিক আয় হয় আট থেকে দশ হাজার টাকা। নাসরিন আক্তারের মতো শাহানাজ, পারুল ও সায়মা সিদ্দিক মুন বাসায় বসে সেলাই ও এমব্রয়ডারি কাজের অর্ডার নিয়ে তা দোকানে সরবরাহ করে চার-পাঁচ হাজার টাকা আয় করেন। তারা নিজেদের তৈরি ফুলতোলা থ্রি-পিস, শাড়ি ও চাদর বিভিন্ন বুটিক হাউসে সরবরাহ করছেন। একইভাবে ঢাকার আরামবাগের ফারহানা আক্তারের নিজস্ব বুটিক হাউস আছে। সেখান থেকে প্রতি মাসে তিনি বেশ কিছু অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হচ্ছেন এবং সংসারকে আর্থিকভাবে সচ্ছল রাখতে ভূমিকা রাখছেন। ফলে পরিবারে ও সমাজে তাদের গুরুত্ব অনেক গুণ বেড়ে গেছে। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বেড়ে যাচ্ছে।
এদের সবাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের আওতায় ঢাকার মতিঝিলে মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেরাই অর্থ উপার্জন করছেন। এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কাটিং ও সেলাই, কম্পিউটার বেসিক কোর্স, কম্পিউটার গ্রাফিকস্ কোর্স, এমব্রয়ডরি, ব্লকপ্রিন্ট ও কনফেকশনারি বিষয়ে তিন মাসের কোর্স চালু আছে। এ ছাড়া শর্টহ্যান্ড বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখানে আরও কয়েকটি নতুন কোর্স চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিউটিফিকেশন, চাইনিজ রান্না, ফ্যাশন ডিজাইন কোর্স ইত্যাদি।
ঢাকার বাইরে বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের আওতায় রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশালে একটি করে মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু আছে। এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে কেউ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, কেউ বাড়িতে বসেই সেলাই, ব্লক, এমব্রয়ডারি করে অর্থ উপার্জন করছেন। এখানে প্রশিক্ষণ শেষে আত্ম-কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অনেকে বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আগ্রহসহকারে এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছু অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হচ্ছেন। বোর্ডের এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে নারীরা যেমন আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন, তেমনি মানবসম্পদ উন্নয়নসহ জাতীয় অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখছেন।
এক হাজারের বেশি নারীকে এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে স্বল্প খরচে প্রতি বছর নারী প্রশিক্ষক দ্বারা প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। মূলত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্ত্রী ও কন্যাদের অত্মনির্ভরশীল ও কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্যে এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়। পূর্বে এখানে কেবল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্ত্রী ও কন্যাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। কিন্তু এখন এ কেন্দ্রগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর আওতায় ৫৩টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে ৬টি মহিলা কারিগরি প্রক্ষিণ কেন্দ্র আছে, যেখানে কেবল মহিলাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানেও দুস্থ, দরিদ্র ও স্বল্পশিক্ষিত নারীসহ শিক্ষিত নারীদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া যুব উন্নয়ন অধিদফতরেও পুরুষের পাশাপাশি নারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ ধরনের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি করে নারীর দক্ষতার উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের অধিক কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী উন্নয়নে বিকল্প নেই। আর এ জন্য নারীদের কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী প্রায় শতকরা ১২ ভাগ। সরকার ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা শতকরা ২০ ভাগে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। দেশে-বিদেশে সব জায়গায় কারিগরি খাতের চাহিদা বেড়েই চলেছে। পুরুষের ন্যায় প্রশিক্ষিত ও দক্ষ নারীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মধ্যম মানের মেধাবী শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানমূলক কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে দেশের ব্যাপক সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বেকার অবস্থায় কালাতিপাত করতে হবে না।
জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম পূর্বশর্ত হলো নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর কর্মময় অংশগ্রহণ বদলে দিতে পারে সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, মানবতা, মানবাধিকার, আর আত্মসম্মানের সূচক। নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন নারী-পুরুষের ভেদাভেদ অনেক গুণ কমিয়ে দিতে পারে। এ উপমহাদেশের নারীমুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রায় শতবর্ষ পূর্বে নারী জাগরণের আহ্বান জানিয়ে লিখেছিলেন, “তোমরা তোমাদের কন্যাগুলিকে শিক্ষা দিয়া ছাড়িয়া দাও, নিজেরা নিজেদের অন্নের সংস্থান করুক।” বেগম রোকেয়ার এ লেখায় নারীর ক্ষমতায়নের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে।
আমাদের দেশে নারীরা শিক্ষায় আগের চেয়ে অনেক অগ্রসর হয়েছে। গত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ছাত্র ও ছাত্রী উভয়ের ক্ষেত্রে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্ত সংখ্যা প্রায় সমান। এ ফলাফল নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক। তারপরও কর্মক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা এখনও অনেক কম। কারগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ সংখ্যা খুব দ্রুত বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
একটি সুষম ও স্থায়িত্বশীল আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। বিপুলসংখ্যক নারী বেকার অথবা সাংসারিক কাজে আবদ্ধ। উন্নয়নের মূল ¯্রােতধারায় সম্পৃক্ত করে নারীদের সম্ভাবনা ও কর্মদক্ষতাকে উৎপাদনমুখী কাজে লাগাতে কারিগরি প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। এ ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীর দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা, শ্রমবাজারে ব্যাপক অংশগ্রহণ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারলে প্রকৃতপক্ষে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে। এতে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হবে এবং গড়ে উঠবে একটি নারীবান্ধব সমাজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন