ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন, অতঃপর কৌশলে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মতো প্রতারণামূলক কর্মকা- উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতারক চক্র এ ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকা- চালিয়ে এলেও অবশেষে ভুক্তভোগীর মাধ্যমেই র্যাব-১ একটি প্রতারক চক্রকে ধরতে সক্ষম হয়েছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের ১২ নাগরিকসহ প্রতারক চক্রের ১৪ সদস্যকে র্যাব-১ গ্রেফতার করেছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে প্রতারণায় ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ মোবাইল ফোনসেট, ল্যাপটপ, ট্যাব, ওয়াইফাই রাউটার, ডিভিডি, পাওয়ার ব্যাংক, পাসপোর্ট ও দেশি-বিদেশি মুদ্রা। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছে নাইজেরিয়ার ৮ জন, কঙ্গোর ১ জন ও ক্যামেরুনের ৩ জন এবং বাংলাদেশের ২ জন। র্যাব-১-এর অধিনায়ক জানান, প্রতারক চক্র সুদর্শন যুবকের ছবি দিয়ে ফেসবুকে ‘স্কট মারে’ ছদ্মনামে ব্রিটিশ নাগরিক পরিচয়ে অ্যাকাউন্ড খোলে। এই আইডি থেকে খুলনার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মকর্তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। একইভাবে ‘ডেসমন্ড বি স্যামুয়েল’ নামে আরেকটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের এক চিকিৎসকের সঙ্গেও বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। ফেসবুক ছাড়াও প্রতারক চক্র তাদের সাথে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ও ট্যাংগো ব্যবহার করে বন্ধুত্বকে আরও গাঢ় করে তোলে। একপর্যায়ে লন্ডন থেকে উপহারের পার্সেল পাঠানো হয়েছে এবং তা কাস্টমস থেকে পরিবহন ব্যয় ও অন্যান্য চার্জ বাবদ ৬০ হাজার টাকা নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে নিয়ে যেতে খুলনার নারী কর্মকর্তাকে বলা হয়। তিনি সরল মনে ওই টাকা দিয়েও দেন। পরবর্তীতে জানতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এ ঘটনা তিনি র্যাব-১-এ জানালে র্যাব অভিযান চালিয়ে ওই ১৪ প্রতারককে গ্রেফতার করে। বলা বাহুল্য, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য প্রতারণামূলক ঘটনার মধ্য থেকে একটি ঘটনা দৃশ্যমান হলো।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণামূলক ঘটনার কথা দীর্ঘদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। প্রতারক চক্রের ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও পরিচয়ে প্রলুব্ধ হয়ে বন্ধুত্বের টানে অনেকেই সরল মনে তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন; প্রেম, পরকীয়াসহ অনৈতিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েছেন। ফেসবুকে বন্ধুত্বের মাধ্যমে অনেকের সংসার ভেঙে গেছে, এমন তথ্যও ফেসবুকে সচেতন ব্যক্তিরা প্রকাশ করেছেন। ফেসবুকে বন্ধুত্বের কারণে গত বছর নাকি কয়েক হাজার ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে অভিজাত এলাকায় এই হার সবচেয়ে বেশি। শুধু সংসার ভাঙা নয়, ফেসবুকে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কারণে অনেকের সংসারে চরম অশান্তিও দেখা দিয়েছে। সংসার ভাঙনের মুখে রয়েছে। অনেক তরুণ-তরুণী নীরবে ব্ল্যাকমেইলিংয়েরও শিকার হচ্ছে। সামাজিক এ সমস্যার পাশাপাশি বন্ধুত্বের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টিও দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। আমরা অনেক আগেই দেখেছি, আফ্রিকার নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ক্যামেরুন, ল্যাসোথো ইত্যাদি দেশ থেকে বিভিন্ন ধনকুবের মহিলা যাদের স্বামী মারা গিয়েছে, তাদের দেখাশোনা ও সম্পদের মালিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মেইল পাঠানো হতো। মেইলের জবাব দেয়ার পর ফিরতি মেইলে ডলার পাঠানোর কথা বলা হতো। অনেকে এ ধরনের মেইলে প্রলুব্ধ হয়ে ডলার পাঠিয়ে প্রতারিত হয়েছে। আবার এমনও দেখা গেছে, একজন বিদেশে গিয়ে তার ডলার, পাসপোর্টসহ সবকিছু হারিয়ে মহাবিপদে পড়েছে বলে দাবি করে জানিয়েছে, তার পাঁচশ’ বা এক হাজার ডলার প্রয়োজন। এই অর্থ নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে পাঠানোর জন্য মানবিক আবেদন করে বলেছে, দেশে এসে এ অর্থ ফেরত দেব। এতে অনেকে অর্থ পাঠিয়েও দিয়েছে। এমনকি আমাদের দেশের অনেক তারকার নাম ব্যবহার করেও এ রকম আবেদন করা হয়েছে। এ ধরনের প্রতারণার পাশাপাশি এখন বন্ধুত্ব স্থাপনের মাধ্যমে উপহার বিনিময় প্রতারণার নতুন কৌশল অবলম্বন করছে প্রতারক চক্র। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদেশি প্রতারক চক্র এখন বাংলাদেশকে টার্গেট করেছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও এর প্রতি মানুষের আগ্রহ এবং এ সম্পর্কে জ্ঞান প্রাথমিক স্তরে থাকার কারণে প্রতারক চক্র বাংলাদেশীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। ইতোমধ্যে আমরা অভিনব উপায়ে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। এটিএম বুথগুলোতে মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বিদেশি জালিয়াতকারী চক্র সহজেই সেগুলোর সিকিউরিটি ভেঙে ফেলতে পারছে। গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বছর দুয়েক আগে মাইক্রোসফট উইন্ডোজ এক্সপিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হালনাগাদের সুবিধা বন্ধ করে দিলেও এই এক্সপি উইন্ডোজ এখনও এটিএম বুথে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাত ও এটিএম বুথগুলো বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। দুর্বল এই সাইবার নিরাপত্তার কারণে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সাইবার আক্রমণ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা অস্বীকার করা যাবে না। যুগের সাথে আমাদেরও তাল মেলাতে হবে। তবে তা আগে বুঝতে হবে। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো যাবে না। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কেউ বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠালে সাথে সাথে গ্রহণ না করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোধ-বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করতে হবে। কেন ও কী কারণে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠানো হয়েছে, তা হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। বন্ধুত্ব মানে ফ্যান্টাসি বা অযাচিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া নয়। এর মধ্যে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ বজায় থাকতে হবে। কারণ ফেসবুকের পাতার অপর পৃষ্ঠার ব্যক্তিটি বন্ধু নাকি বন্ধুবেশী প্রতারক, তা শুধু ছবি দেখে আর সংক্ষিপ্ত চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে বোঝা সম্ভব নয়। প্রতারিত হয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হওয়ার আগেই সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিস্তৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোথায় কে কীভাবে প্রতারিত হচ্ছে, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে কোনোভাবেই মনিটর করা সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তখনই ব্যবস্থা নিতে পারবে, যখন তারা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাবে। এ ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতেই র্যাব-১ একটি প্রতারক চক্রকে ধরতে সক্ষম হয়েছে। আমরা আশা করব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের প্রতারণাপূর্ণ কর্মকা-ের বিষয়গুলো নিয়মিত মনিটরিং করবে এবং একটি প্রতারক চক্রের সূত্র ধরে অন্য প্রতারক চক্রকেও শনাক্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। র্যাব-১ যে কাজটি করেছে, আমরা তার জন্য সাধুবাদ জানাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন