শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

এরাই মুসলমানদের প্রকৃত শত্রু

| প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে পপ কনসার্টে ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা বিষ্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় আমরা শোকাহত, ক্ষুব্ধ। এ ঘটনার নিন্দা ও ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের নেই। সেখানকার একটি ইনডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত ওই কনসার্টে কিশোর ও তরুণদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় মার্কিন গায়িকা আরিয়ানা গ্রান্ডির গান পরিবেশনার সময় এই বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। স্টেডিয়ামে প্রায় ২১ হাজার দশর্কের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। যার আসনগুলো ছিল পরিপূর্ণ এবং শ্রোতাদের বেশিরভাগই ছিল শিশু, কিশোর ও তরুণ। যখন শ্রোতারা তাদের প্রিয় শিল্পীর মনমুগ্ধকর পরিবেশনায় বাঁধভাঙা আনন্দে উদ্বেলিত ঠিক তখনই আত্মঘাতী সন্ত্রাসী বোমা বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে গোটা দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। রক্ত, আর্তচিৎকার, ভীতি ও বিষাদের এক অবর্ণনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় অন্তত ২২ জন নিহত ও ৬০ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে শিশু ও কিশোরও রয়েছে। আত্মঘাতী হামলাকারীর পরিচয় প্রকাশ করেছে ব্রিটেনের পুলিশ। বিবিসি জানিয়েছে, পুলিশের ধারণা, হামলাকারীর নাম সালমান আবেদি। ২২ বছর বয়সের ওই তরুণের জন্ম ম্যানচেস্টারে এবং তার পরিবার এসেছে লিবিয়া থেকে। ম্যানচেস্টারের পুলিশ জানিয়েছে, সে একাই হামলা চালিয়েছে নাকি তার আরো কোনো সহযোগী ছিল, এখন তাদের অনুসন্ধানে সেটাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সন্দেহে ইতোমধ্যে পুলিশ চার্লটন এলাকা থেকে এক তরুণীকে গ্রেফতার করেছে। সিরিয়ার জঙ্গিগোষ্ঠি আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করেছে, তবে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয়নি। উল্লেখ করা যেতে পারে, দু’ মাস আগে ওয়েস্টমিনিস্টার পার্লাামেন্টের বাইরে এবং পার্শ্ববর্তী সেতুতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। তাতে চার জন নিহত ও পুলিশ সদস্যসহ ২০ জন আহত হয়। এর আগে ২০০৫ সালে সবচেয়ে বড় হামলাটি হয় লন্ডনের পাতাল রেলে। সেই হামলায় বহু মানুষ হতাহত হয়। শুধু ব্রিটেন নয়, ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা ও হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এসব হামলায় মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততার কথা উঠে এসেছে। অধিকাংশ হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস বা অন্য কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক বাস্তবতা যে, ইউরোপসহ পাশ্চিমা দেশগুলোতে যে কোনো সন্ত্রাসী হামলার পর মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি বিব্রত, শঙ্কিত, ক্ষতি, নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এমনভাবে মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণা চালায় যাতে মুসলমানদের সম্পর্কে অন্যান্য জাতি-সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি ও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে এও দেখ যায়, বিশ্বব্যাপী জঙ্গি হামলা ও সন্ত্রাসের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে মুসলমানরাই। কাজেই যারা এসব হামলা করছে, হামলার প্ররোচনা, সহায়তা ও মদদ দিচ্ছে তারা মুসলমানদের মিত্র নয়। এরাই মুসলমানদের প্রকৃত শত্রু।
নিরীহ মানুষ হত্যা করে, কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যায় না, কোনো বিপ্লব সাধন করা যায় না, কোনো সংগ্রামে সাফল্য অর্জন করা যায় না। ইতিহাসে এর বহু সাক্ষ্য বিদ্যমান রয়েছে। ইসলাম একটি বৈপ্লবিক আদর্শ। তার প্রতিষ্ঠা যুদ্ধ, রক্ত কিংবা হত্যার মাধ্যমে হয়নি। দাওয়াত, মানবিক আচরন ও দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ইসলামে নিরীহ মানুষ হত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ভীতি প্রদর্শন, সন্ত্রাস, জুলুম, পীড়ন, নির্যাতনকে ইসলাম বিন্দুমাত্র সমর্থন করে না। আজ যারা ইসলামের নামে মানুষ হত্যা করছে, বোমাবাজি করছে, সন্ত্রাস করছে, তারা ইসলামের অনুসারী বলে বিবেচিত হতে পারে না। তাদের কারণে ইসলামের দুর্নাম হচ্ছে, মুসলমানরা মুখ দেখাতে পারছে না। অন্যরা মুসলমানদের যত না ক্ষতি করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করছে মুসলমান নামধারী এ সন্ত্রাসীরাই। আজকে গোটা বিশ্বে ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে, কিন্তু ইসলাম সর্বাপেক্ষা মানবিক ও প্রাকৃতিক ধর্ম বা আদর্শ। মুসলমানদের চিহ্নিত করা হচ্ছে ঘাতক-সন্ত্রাসী ও দানব হিসাবে। অথচ প্রকৃত মুসলমানদের চেয়ে মানবিক, হিতৈষি ও কল্যাণকামী মানুষ আর কোনো ধর্ম বা আদর্শ উপহার দেয়ার সক্ষমতা রাখে না। এই যে ইসলামের অপনাম, মুসলমানদের দুর্নাম তা ঘোচাতে হলে মুসলমানদেরই এগিয়ে এসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। সউদী বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ এর মধ্যেই একটি বড় কাজ করে ফেলেছেন। এআইএ সম্মেলনের আয়োজন করে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান সুনির্দিষ্ট করেছেন। সম্মেলনে অর্ধশতাধিক মুসলিম দেশের রাষ্ট্রনেতারা জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থান ঘোষণা করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলিম রাষ্ট্রনেতাদের সামনে যে ভাষণ দিয়েছেন, তা ব্যতিক্রমী ভাষণ আলোচিত হচ্ছে। যিনি একদা ইসলামকে ঘৃণার চোখে দেখতেন সেই ট্রাম্পই বলেছেন, ইসলাম এক মহৎ ধর্ম। তিনি বলেছেন, একজন সন্ত্রাসী যখন নিরাপরাধ লোককে হত্যা করে এবং সৃষ্টিকর্তার নাম নেয় তখন ধর্মবিশ্বাসী সব মানুষকে অবমাননা করা হয়। তার এ কথায় যথার্থতা প্রশ্নাতীত। দুঃখজনক হলো, এত বড় একটি সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পরপরই ম্যানচেস্টারে হামলা ও হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। কী অপরাধ ছিল পপ কনসার্টে আগত শিশু, কিশোর ও তরুণদের? কোনো অপরাধই ছিল না। এ পর্যন্ত সন্ত্রাসী হামলায় যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের কারো কোনো অপরাধ ছিল না। কিন্তু তারা বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হয়েছেন।
ইসলামের নামে যারা মানুষ হত্যা করছে, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে, কোনো বিবেচনাতেই তারা মাফ বা মার্জনা পেতে পারে না। যেহেতু তাদের সীমাহীন বর্বরতা, অপকর্ম ও অপরাধের জন্য ইসলামের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে, মুসলমানদের সমূহ ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে; সুতরাং তাদের প্রতিহত করার জন্য মুসলমানদের দৃঢ় ভূমিকা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। মুসলিম দেশগুলোর ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের উত্থানের পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আছে, প্ররোচনা আছে, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও যুদ্ধের প্রতিক্রিয়াও আছে। একই সঙ্গে আছে নির্বুদ্ধিতা ও ভ্রান্ত আদর্শবিলাস। লক্ষ্য করা গেছে, তরুণদের একাংশই বিশেষভাবে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, যাদের না ইসলাম সম্পর্কে প্রকৃষ্ট ধারণা, না আছে উপযুক্ত শিক্ষা ও জ্ঞান। আজকে মুসলিম প্রতিটি পরিবারকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে, যাতে তরুণরা প্ররোচনা ও বিভ্রান্তিতে পড়ে বিপথগামী না হয়। প্রতিটি মুসলিম সমাজকে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোরও একাট্টা হয়ে নামতে হবে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। মুসলিম পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যদি জেগে ওঠে, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে সম্ভাব্য কর্মকৌশল অবলম্বন করে, তবে আশা করা যায়, ইসলামের নামে সৃষ্ট জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটতে দেরি হবে না। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার বিস্তার ঘটনো যেমন দারকার তেমনি ভ্রান্ত বিশ্বাস বা ধারণা দূর করার পদক্ষেপও প্রয়োজন। মুসলিম দেশসহ গোটা বিশ্বের উলেমা সমাজ এ ক্ষেত্রে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখতে পারে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদকে সর্বোচ্চ শক্তি ও সক্ষমতা দিয়ে ‘না’ বলতে হবে। পরিশেষে ম্যানচেস্টারে বিস্ফোরণের ঘটনায় যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের পরিবার-পরিজনসহ সেদেশের সরকার ও জনগণের প্রতি আমরা গভীর সহমর্তিতা জ্ঞাপন করছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন