শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগ চাই

প্রকাশের সময় : ২৬ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৬ এএম, ২৬ মে, ২০১৭

প্রকৃতির বিরূপ আচরণের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছি আমরা। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, অকালবন্যা এবং সারাদেশে চলমান দাবদাহ, অসহ্য গরম জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের সাম্প্রতিক এবং চলমান অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির এহেন হেঁয়ালিপনায় আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, বাস্তুনিরাপত্তা, জীবনযাপনের স্বাভাবিক  ও সাধারণ উপাত্তগুলো ক্রমশ: বিপন্ন হয়ে চলেছে। গত চৈত্র-বৈশাখের অতিবর্ষণে তিরিশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রের্কড সৃষ্টি হয়েছে। সেই সাথে উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে সৃষ্ট আকষ্মিক বন্যায় সীমান্তবর্তি বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর জমির আধপাকা বোরোধান তলিয়ে গেছে। লাখ লাখ কৃষকের ভাগ্য বিপর্যয়ে এখন হাওরাঞ্চলে হাহাকার চলছে। কিছুদিন আগেও হাওরাঞ্চলে যারা সম্পন্ন গৃহস্থ হিসেবে পরিচিত ছিলেন এখন সব ফসল হারিয়ে, পানির দূষণে মাছ হারিয়ে নি:স্ব অসহায় হয়ে পড়েছেন। এভাবেই আমাদের চোখের সামনে ক্রমশ প্রকট আকারে ধরা পড়ছে বিশ্বের উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের রূদ্র প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশে ঋতু পরিবর্তনে আবহমানকালের অভিজ্ঞতাও যেন এখন দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করেছে। আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ ধারায় শীত ও গ্রীষ্মের তীব্রতা আরো প্রকটভাবে অনুভ’ত হওয়ার কথা থাকলেও এবারের শীতে তাপমাত্রা তেমন না কমলেও চলমান জৈষ্ঠের তাপদাহে জনজীবন এখন অতীষ্ট ও দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। সেই সাথে নতুন নতুন রোগ-ব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ঝুঁকি এবং বিপদ সম্পর্কে আমরা অনেক আগে থেকে নানা ধরনের বার্তা পাচ্ছি বটে, এসব বার্তাকে আমাদের সরকার তেমন পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে হয়না। সরকারের নীতি নির্ধারণ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তার কোন প্রতিফলন চোখে পড়েনা। যদিও বিশ্বের উষ্ণায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন কোন একক দেশের ইস্যু নয়, এটি একটি বৈশ্বিক ইস্যু। মূলত: শিল্পোন্নত বিশ্বের অতিমাত্রায় ফসিল জ্বালানীর ব্যবহার, অপরিনামদর্শি শিল্পায়ণ নগরায়ণ এবং বনভ’মি নাশ, নদী, জলাভ’মি ও পাহাড়ের ভ’-প্রকৃতি বিনষ্টের মধ্য দিয়ে অতিমাত্রায় কাবর্ন ইমিশনের কারণে সারাবিশ্ব এখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। এ কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন, অন্যদিকে প্রতিটি দেশ এবং স্থানীয় জনপদকেও জলবায়ু ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ও জীবন-জীবীকা নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নদনদীবাহিত পলি দিয়ে সৃষ্ট বাংলাদেশের জলবায়ু ও জীববৈচিত্রের সাথে নদীর সম্পর্ক নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। যৌথ নদীর উপর উজানে ভারতের একতরফা বাঁধ নির্মান, নদীশাসন, পানিপ্রত্যাহার আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবন-জীবীকার জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করেছে। নদীতে নাব্যতা হ্রাস ও নদী ভাঙ্গনের ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে আমাদের সরকারের ব্যর্থতায় দেশের মানুষকে অনেক বেশী মূল্য দিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। নদ নদীর নাব্যতা, প্রবাহমানতা, পানি ও বায়ু দূষনের বিষয়গুলোকে যথাযথভাবে মোকাবেলা না করে তথাকথিত উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প টেকসই উন্নয়নে তেমন কোন কাজে আসবেনা। অবকাঠামো উন্নয়নের চাইতে, নদী , হাওর, বিল, বনভ’মি ও জলাভ’মি রক্ষা করা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।  
পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন মানে হচ্ছে, জনগনের অর্থনৈতিক ও জীবনমানের উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ-প্রতিবেশগত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশ্বের উষ্ণায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন একদিনে বা দু’চার বছরেই সংঘটিত হয়নি, রাতারাতি তার প্রতিরোধ ও প্রতিবিধানও সম্ভব নয়। এই মুহর্তে প্রতিবছর বিশ্বের  লাখ লাখ মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিনত হচ্ছে। বলা যায়, এর একটি বড় অংশই বাংলাদেশের। নদীভাঙ্গন, হাওরের ফসলহানি, ক্ষরা, বন্যা ও মঙ্গায় প্রতিবছর যে সব লোক জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমায় তারা প্রায় সকলেই জলবায়ু উদ্বাস্তু। গেøাবাল ওয়ার্মিং এর চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দশকের শেষে হিমালয়ের বরফ গলে সাগরবক্ষের উচ্চতা অন্তত এক মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের প্রায় চারকোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিনত হবে। এত বিপুল সংখ্যক বাস্তুহীন মানুষের চাপ বহনের ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। অতএব এখন থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগ ও প্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে। উপকুলীয় সবুজ বেষ্টনী, বনভ’মি, নদী, জলাভ’মি ও পাহাড়ের জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ক্লাইমেট চেঞ্জ মিটিগেশনের আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্য আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহনের পাশাপাশি নদীগুলোর পানিপ্রবাহ ও নাব্যতা রক্ষায় দেশিয় ও আঞ্চলিক উদ্যোগ নিতে হবে। নদীগুলোতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং, ভাঙ্গন প্রতিরোধ এবং পানিদূষণের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। কয়লা ও ফসিল জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের প্রতি লক্ষ্য রেখে উন্নয়ন ও উৎপাদন প্রকল্প গ্রহন করতে হবে। উন্নয়নের গতানুগতিক ধারনা পরিহার করে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবী। 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন