মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : শিশু হত্যার উৎসবের পর এবার চলছে ধর্ষণ সিরিজ। প্রায়ই পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে যৌন নির্যাতনের নির্মমতার খবর। অহরহ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু, তরুণী, কর্মজীবী নারী। ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদ এখন আর কাউকে আলোড়িত করছে না। সবই যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। ট্রেনের নিচে বাবা-মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা মোটেও সুখকর নয়। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের নাগরিকদের সিংভাগ যদি নৈতিক অধঃপতনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয় তখন সে রাষ্ট্রের পক্ষে দায়িত্ব পালন করা কঠিন। এই বিষয়টি যারা ক্ষমতায় আছেন এবং যারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে আন্দোলন সংগ্রাম করছেন তাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীর ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা একটি উপসর্গ মাত্র। নইলে একজন ধনাঢ্য বাবার মুখ থেকে এমন অরুচিকর মন্তব্য কেন জাতিকে শুনতে হবে? এতে স্পষ্ট, উচ্চবিত্তের একশ্রেণীর নীতিভ্রষ্ট দুশ্চরিত্র মা-বাবার কারণে অনেক সন্তান বিপথগামী হচ্ছে। রেইনট্রি হোটেলের দুই শিক্ষার্থীর ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা যদি গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হতো তাহলে আরও কত নারীর ইজ্জত যে লুটেরা লুটে নিত তা আল্লাহ মালুম। আল্লাহ তায়ালার গযব লূত জাতির উপর এমনি এমনি পড়েনি এটা সকলের মনে রাখা প্রয়োজন। ধর্ষণ যেন সংক্রামক জীবাণুর মতো ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে। এই তো সেদিন গাজীপুরের শ্রীপুরে বাবা-মেয়ে বিচার না পেয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহনের পথকে বেছে নিয়েছে। তাঁর এই মৃত্যু সমাজের নোংরা চেহারাটাকে জাতির সামনে উন্মোচিত করছে। হজরত আলী ও আয়েশা মরেনি। প্রতিকার ও প্রতিরোধহীন নির্বিকার অকৃতজ্ঞ রাষ্ট্রকে ধিক্কার জানিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে গেছে। তারপরেও ধর্ষণের বিভীষিকা থেমে নেই।
যে সমাজ বা রাষ্ট্রের মেয়েশিশুরা লম্পট চরিত্রহীন পুরুষদের লালসার শিকার হয়, সে সমাজকে নষ্ট সমাজকে ব্যতিত আর কী বলা যেতে পারে! একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে বড় বড় ব্রিজ কালভার্ট আর উঁচু দালান নির্মাণ হলেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না। আইনের শাসনের জন্য প্রয়োজন নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা। দন্ডবিধির ধারা নং ৩৭৫ এ ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আর শাস্তির কথা দন্ডবিধির ৩৭৬ ধারাতে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই ধারাটিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ধর্ষণের অপরাধ করে, তবে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম অথবা বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবে এবং অর্থ দন্ডে দন্ডিত হবে। আইন থাকার পরও কেন ধর্ষণের বীভৎসতা বেড়েই চলেছে সে বিষয়টি আমাদের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমরা ধর্ষণকে ঘৃণার চোখে দেখি, এটা সত্য কথা। কিন্তু ধর্মীয় দিক থেকে ধর্ষণ যে বড় ধরনের ঘৃণ্য একটি পাপ তা অনুধাবন করছি না। এমনকি ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবে যে ধর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাও আমরা বলতে পারছি না। আইনের দৃষ্টিতে সম্মতির ভিত্তিতে যৌনসংগম ধর্ষণ না হলেও ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিতে স্ত্রী ব্যতিত অপর কোন নারীর সঙ্গে যেকোনো ধরনের যৌনসংগম হচ্ছে গুরুত্বর অপরাধ। মহান আরশের অধিপতি আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে আল কুরআনের সূরা বনী ইসরাঈলের ৩২ নম্বর আয়াতে বলে দিয়েছেন যে, তোমরা যেনার ধারে কাছেও যেয়ো না, নিঃসন্দেহে এটি হচ্ছে একটি অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট পথ।
প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষিতার চেয়ে রাষ্ট্রের বেশি লজ্জা পাওয়া উচিত। ধর্ষণ বৃদ্ধির কারণে রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল। আমরা হয়ত অনেকে লুক্রেসিয়ার কথা ভুলে গেছি। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে লুক্রেসিয়ার নাম। রোমান সাম্রাজ্যের শেষ রাজার গুণধর পুত্র লুক্রেসিয়াকে ধর্ষণ করেছিল। কিন্তু লুক্রেসিয়া বিচার প্রার্থনা করেও বিচার পায়নি। অবশেষে একটা ছুরি নিজের বুকে বসিয়ে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনায় জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শুরু হয় রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, রাজনৈতিক বিপ্লব। রোমান সেনাবাহিনীও জনগণের বিদ্রোহকে সমর্থন জানায়। পতন ঘটে রোমান সাম্রাজ্যের। সুইডেনের বর্তমান উপপ্রধানমন্ত্রী মারগট ওয়ালস্ট্রম জাতিসংঘ মহাসচিবের যৌন সহিংসতা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি হিসিবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১০ সালে তিনি একবার আফ্রিকার দেশ কঙ্গো সফরে যান। সফরের বিস্তারিত বিবরণ নিরাপত্তা পরিষদকে বর্ণনা করার সময় ওয়ালস্ট্রম বলেন, বিশ্বে ধর্ষণের রাজধানী হলো আফ্রিকার দেশ কঙ্গো। সেখানে নারীরা অব্যাহতভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তবে এটা এই কারণে নয় যে তাঁদের রক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত আইন নেই। বরং আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে এসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ওয়ালস্ট্রম যখন কঙ্গো সফরে যান তখন দেশটি গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। ১৯৯৮ সালে এ গৃহযুদ্ধ শরু হয়ে ২০০৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলেও এর জের ছিল বহুদিন। অর্থাৎ একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সেই সময় প্রতিদিন গড়ে ১১শত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি ঘণ্টায় ধর্ষিত হয়েছে ৪৮ জন। আমাদের দেশে প্রতিদিনই এ ভয়াবহ বা অমানবিক ঘটনা ঘটছে। এই সকল ঘটনা এমনই মর্মান্তিক যে ঘটনাটি শুনলে যে কারো হৃদয় রক্তাক্ত না হয়ে পারে না। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশ আফ্রিকার মঙ্গোলিয়া বা রোমান সাম্রাজ্য না হলেও ধর্ষণের পরিসংখ্যানের চিত্রটা মোটেও সুখকর নয়। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো।
নারী অধিকার বিষয়ক সংস্থা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব মতে, দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে প্রায় দেড় হাজার ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৫৮টি ধর্ষণ ও ৫৫টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে।ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৫ জনকে। ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটে ৬০টি। ২০১৭ সালের প্রথম চার মাসে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু পাচার, যৌন নিপীড়ন, আত্মহত্যা, বাল্যবিয়ে, অপহরণ ছাড়াও বিভিন্নভাবে এক হাজার ৫৬৬ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জানুয়ারিতে ৫৮, ফেব্রুয়ারিতে ৬২, মার্চে ৭১ ও এপ্রিল মাসে ৬৭ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। অন্যদিকে গত বছর ৮৪০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) ২৮০জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়। এ ছাড়া এ বছরের জানুয়ারি মাসে ১৪, ফেব্রুয়ারিতে ১৩, মার্চে ১৪ ও এপ্রিলে ১৪ নারী গণধর্ষণের শিকার। ২০১৬ সালে মোট গণধর্ষণের ঘটনা ছিল ১৬৬টি।
ধর্ষণ বৃদ্ধির সব কারণ উল্লেখ করলে সমাপ্তি টানা যাবে না। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ধর্ষণের যে রুট রয়েছে তা আগে বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা আগেও ছিল এবং ভবিষ্যতেও হয়তো তা পরিপূর্ণভাবে দূর করা সম্ভব হবে না। তবে কয়েকটি পদক্ষেপ যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে নেওয়া যায় তাহলে ধর্ষণের ঘটনা কমবে। যেমন ব্লফিল্ম, পর্নসাহিত্য, অশ্লীল ম্যাগাজিন, অশ্লীল ছায়াছবি, অশালীন পোশাক, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর নামে অশ্লীলতা, তরুণ তরুণীদের হোটেলে অবাধ চলাফেলার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার বাড়ানো এবং ইসলামের সোনালী দিনের ইতিহাস ও রাসূলের উত্তম চরিত্রের গুণাবলী যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে তরুণ তরুণীদেরকে শিক্ষা দেয়া যায়, তাহলে ধর্ষণের বীভৎসতার হাত থেকে হাজারো নারীর ইজ্জতকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন