যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের ডিপ্লোমেটিক জোনে গাড়িবোমা বিষ্ফোরণে প্রায় ৯০ জন নিহত এবং চারশতাধিক লোক আহত হয়েছেন। ২০০১ সালের শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোর বিমান হামলা ও দখলদারিত্বের পর থেকেই রাজধানীসহ আফগান শহরগুলো চরম অস্থির-অনিরাপদ হয়ে আছে। দেড় দশক ধরে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে তালেবান যোদ্ধাদের নেটওয়ার্ক ধ্বংস বা অকেজো করতে পারেনি, হানাহানি রক্তক্ষয়ও বন্ধ করতে পারেনি পশ্চিমা সামরিক জোট। একই অবস্থা বিরাজ করছে বাগদাদসহ ইরাকের অন্যান্য শহরেও । মাঝে মধ্যেই ভয়ঙ্কর সব আত্মঘাতি গাড়িবোমা হামলায় সেখানে নিহত ও রক্তাক্ত হচ্ছে নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুরা। এ যাবৎ এভাবে অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়েছে। দশক ধরে পশ্চিমা বিমান হামলা ও সামরিক আগ্রাসনে লাখ লাখ মানুষের হতাহত ও উদ্বাস্তু হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনেও পশ্চিমাদের ইন্ধন রয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানের মত রাষ্ট্রের উপর মিথ্যা অজুহাতে বর্বর সামরিক আগ্রাসন চালিয়েও সামরিক বা রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করতে ব্যর্থ হয়ে এখন এসব দেশে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠির উত্থান ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে পশ্চিমারা। বুধবার সকালে কাবুলের কূটনৈতিক পাড়ায় সংঘটিত বোমা হামলার পর কেউ দায় স্বীকার করেনি। গত দশকের মধ্যে সম্ভবত এটিই হচ্ছে কাবুলে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও শক্তিশালী গাড়িবোমা হামলা। এর আগে গত এপ্রিলে মার্কিন বিমান বাহিনী আফগানিস্তানে এ যাবৎকালের বৃহত্তম বোমা ‘মাদার অব অল বোম্বস’ ফেলে শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছিল, যাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক।
ইরাক ও আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যে আত্মঘাতি হামলা ও জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় প্রতিয়মান হয়, কথিত জঙ্গিবাদি হামলা মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে ইউরোপেও বিস্তৃত হয়ে চলেছে। গত সপ্তায় যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে একটি কনসার্টে কথিত আত্মঘাতি বোমার বিস্ফোরণে প্রায় দুই ডজন মানুষ নিহত এবং আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক । এসব সন্ত্রাসী হামলায় সাধারণত আইএস’র পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করা হলেও ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত এবং প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ কখনো দেখা যায়নি। এ কারণে অনেকেই এসব সন্ত্রাসী হামলাকে ইসলাম বিদ্বেষী পশ্চিমাদের ফল্স ফ্লাগ বলে আখ্যায়িত করতে দেখা যায়। তবে এসব হামলার জন্য যে বা যারাই দায়ী বা জড়িত থাক না কেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রান দিচ্ছে নিরপরাধ মুসলমানরাই। আর যে সব পশ্চিমা দেশে এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হচ্ছে তার দায়ও মুসলমানদের উপর চাপছে। নানাভাবে এর মাশুল মুসলমানদেরকেই গুনতে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে সারাবিশ্বের মুসলমানরা এখন সামরিক সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকারে পরিনত হয়েছে।
সম্প্রতি সউদি আরবে অনুষ্ঠিত আরব ইসলামিক-আমেরিকা (এআইএ) সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেছেন, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের ভিকটিমদের শতকরা ৯৫ ভাগই মুসলমান। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ যে একটি বৈশ্বিক সমস্যা তাতে কোন সন্দেহ নাই। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ,আমেরিকা, আফ্রিকা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের হুমকির সম্মুখীন। জুলুমের প্রতিবাদ বা চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মোকাবেলা ছাড়া কোন নিরপরাধ মানুষ হত্যা ইসলাম সমর্থন করেনা। কোরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানব জাতিকেই হত্যা করল। অনুরূপভাবে যদি কেউ একটি মানুষের প্রান রক্ষা করল সে যেন সকল মানুষের প্রান রক্ষা করল’(কোরআন ৫:৩২)। একইভাবে বিশৃঙ্খলা ও ফিতনা সৃষ্টিকারীদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বিশেষ হুশিয়ারি ও সাবধানবানী উচ্চারিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে নানা ধরনের আক্বিদাগত মত পার্থক্য এবং অসহিষ্ণুতাকে পুঁজি করে ইসলামের শত্রুরা ইসলাম বিদ্বেষী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মিশরে কপটিক খৃষ্টানদের উপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা, ঢাকায় হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা অথবা মসজিদের ইমাম বা ভিন্ন মতাবলম্বিদের হত্যার ঘটনাকে যারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিষয় বলে চাপিয়ে দিতে চায় তারাই এসব অপকর্মের নেপথ্য কুশীলব। বাগদাদে, কাবুলে, দামেস্কে, কায়রোতে, ঢাকায়, ব্রাসেলসে বা মানচেস্টারে যেখানেই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কোন না কোন ইসলামি জঙ্গিবাদি গোষ্ঠির নাম এসে যাচ্ছে। এটা ইসলাম ও মুসলিম বিরোধি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। শুধুমাত্র ইসলাম ও মুসলমানদের উপর দোষ চাপিয়ে এ ধরনের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য সমস্যার মূলে হাত দিতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের প্রলম্বিত সামরিক আগ্রাসন ও রিজিম চেঞ্জ’র ভুল নীতির কারনে যে সমস্যার সৃষ্টি তা সংশ্লিষ্ট পক্ষকে দায় নিয়ে নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমেই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। কাবুলের কূটনৈতিক পাড়ায় গাড়িবোমা হামলায় বিদেশি কূটনীতিকরা অক্ষত থাকলেও হতাহত হয়েছেন মূলত: নিরপরাধ মুসলমান নাগরিকরা। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পশ্চিমা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর শুভবুদ্ধির উদয় এবং তাদের কাছ থেকে আমরা সময়োপযোগি পদক্ষেপ প্রত্যাশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন