ফের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে লন্ডন। পার্লামেন্ট নির্বাচনের চারদিন আগে এবং ম্যানচেস্টার হামলার ১২ দিনের মাথায় শনিবার রাতে লন্ডন ব্রিজ ও বারো মার্কেটে সন্ত্রাসীরা ভ্যান ও ছুরি নিয়ে হামলা চালায়। এতে ৭ জন নিহত ও ৪৮ জন আহত হয়েছে। হতাহতের মধ্যে ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে এই হামলাকে ভয়ংকর ঘটনা বলে বর্ণনা করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ বর্বরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ব্রিটেনের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। গত ২২ মে ম্যানচেস্টারের একটি ইনডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত পপ কনসার্টে আত্মঘাতী হামলার ঘটনায় অন্তত ২২ জন নিহত ও ৬০ জন আহত হয়। এ ঘটনায় রেশ কাটতে না কাটতেই লন্ডন ব্রিজ ও বারো মার্কেটে হামলার ঘটনা ঘটলো। হামলকারী ৩ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। তাদের পরিচয় জানা যায়নি। ম্যানচেস্টারে পপ কনসার্টে হামলার দায় স্বীকার করে আইএস। সর্বশেষ হামলায় দায়ও আইএস নিয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয়, লন্ডন বার বার সন্ত্রাসী হামলায় শিকার হচ্ছে। মাস দু’য়েক আগে ওয়েস্টমিনিস্টার পার্লামেন্টের বাইরে ও পার্শ্ববর্তী সেতুতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ৪ জন নিহত ও পুলিশসহ ২০ জন আহত হয়। অর্থাৎ দু’মাসে তিন হামলায় ৩৪ জন নিহত ও দেড়শ’র কাছাকাছি মানুষ আহত হয়েছে। ২০০৫ সালে সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনাটি ঘটে লন্ডনের পাতাল রেলে। সেই হামলায় বহু লোক হতাহত হয়। পর্যবেক্ষক মহল লক্ষ্য করে থাকবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লন্ডন ও প্যারিসসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে এবং নিরিহ ও সাধারণ মানুষ হতাহত হচ্ছে। এ যাবৎ যত হামলার ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশের দায় স্বীকার করেছে ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক আইএস।
উগ্রবাদী সংগঠনগুলো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেনে বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশকে দায়ী করে। এসব দেশে সন্ত্রাসী হামলা তারই ‘প্রতিশোধ’ বলেই তারা প্রচার করে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী চক্র মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে আগ্রাসন, হামলা, সংঘাত, প্রাণহানি, উৎখাত ইত্যাদির মাধ্যমে যে নিরাপত্তাহীন, বিশৃংখল, বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, সংশ্লিষ্ট ওই সব দেশের সাধারণ মানুষ তার বিরোধী। তাদের আগ্রাসন ও যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ, সমাবেশ ও অবস্থান থেকেই তা স্পষ্ট। অথচ সন্ত্রাসীরা ইসলাম ও মুসলমানের নাম করে তাদের ওপরই হামলা চালাচ্ছে। যারা এভাবে সন্ত্রাস করছে, মানুষ হত্যা করছে, তারা আসলে ইসলাম ও মুসলমানের মিত্র নয়। ইসলামে নিরহ, নিরপরাধ মানুষ হত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোনো মুসলমান মানুষ হত্যা করতে পারে না। ইসলাম ও মুসলমানের নামে মানুষ হত্যা করে তারা ইসলাম ও মুসলমানদেরই ক্ষতি করছে। ইউরোপ-আমেরিকার অমুসলিমদের, যারা মানবতাবাদী; সহৃদয়, সহানুভূতিশীল; ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ন করে তুলছে। সন্ত্রাসীরা প্রকৃতপক্ষে ‘ছদ্মবেশী শত্রু’ মুসলমানদের। বিশ্বের ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার এবং মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করার অবিরাম তৎপরতা চালিয়ে আসছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মূল কথাও মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসাবে সাব্যস্ত করে দমন ও নির্মূল করা। যারা ইসলামের নামে সন্ত্রাসী হামলা ও মানুষ হত্যা করছে তারাও মূলত সেই কাজই করছে যা করছে ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী শক্তিগুলো। সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী মুসলিম বিদ্বেষ বাড়ছে এবং সর্বত্র মুসলমানরা নিগ্রহ, বৈষম্য, বঞ্চনা, বিদ্বেষ ও বৈরিতার শিকার হচ্ছে। হামলার শিকারও হচ্ছে।
কাজেই যারা সন্ত্রাসী হামলা করে মানুষ হত্যা করছে, ইসলাম ও মুসলমানদের নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, করছে, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার, প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। সারাবিশ্বের আলেম-ওলামা এ ব্যাপারে একমত কোনো ধরনের সন্ত্রাস, নাশকতা, হত্যা, হত্যার জন্য হামলা ইসলাম সমর্থন করে না। অনেকে বিভ্রান্ত, বিক্ষুব্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত বা প্ররোচিত হয়ে সন্ত্রাসের পথে পা বাড়াতে পারে। তাদের রুখতে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার, মানবিক ঐশ্বর্যের কথা তুলে ধরতে হবে। অন্যদিকে সকল প্রকার সন্ত্রাস ও হত্যাকান্ডের বিপরীতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে মুসলমানদের অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস নির্মূলে যে তৎপরতা চলছে তা কার্যকর সুফল দিচ্ছে না কেন, সেটা সংশ্লিষ্টদের খুঁজে বের করতে হবে। সন্ত্রাসের আসল কারণ ও উৎসগুলো অনুসন্ধান করে তা যত দ্রæত সম্ভব দূর করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধ ও সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার অবসান ঘটাতে হবে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও অন্যান্য প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোকে একজোট হয়ে আন্তরিক ভূমিকা রাখতে হবে। আমরা জানি, লন্ডন বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান ও প্রভাবশালী শহর। সেখানে বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের বিপুল সংখ্যাক মানুষ বসবাস করে। বিট্রিশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ মুসলমান সেখানে রয়েছে। ব্রিটিশ সমাজসহ সকল ক্ষেত্রেই তারা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। লন্ডনে বা ব্রিটেনে সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলায় সেখানকার আলেম-ওলামা ও মুসলমানদের তাই জোর ভূমিকা রাখতে হবে। সামাজিকভাবে, জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসীদের রুখে দিতে হবে। শুধু সেখানেই নয়, বিশ্বের সব দেশ, সব স্থানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে। আমরা লন্ডনের আলোচ্য সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা করি, সন্ত্রাসের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ও মদদদাতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করি এবং হতাহতদের পরিবার-পরিজন, সরকার ও জনগণের প্রতি জানাই গভীর সহমর্মিতা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন