এবারের বাজেটকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট বলেছেন। বাজেট নিয়ে তাকে বেশ উচ্ছ¡াস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তবে তার এই শ্রেষ্ঠ বাজেট নিয়ে এখন অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে সংসদ সদস্যরা পর্যন্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। বলা যায়, এ বাজেটকে তারা তুলোধুনো করছেন। সাধারণত বাজেট নিয়ে আলোচনার সময় সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা বাজেটের সাফাই গাওয়া শুরু করেন। বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য কি যোগ্য না, এ বিবেচনা না করেই বলতে থাকেন বাস্তবায়নযোগ্য। বাজেট বাস্তবায়ন হলে দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাবে, সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এবারের বাজেট নিয়ে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। সরকারি দলের সংসদ সদস্যরাই বাজেটের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে তা সংশোধনের প্রস্তাব তুলছেন। বিশেষ করে ব্যাংকে আমানতের উপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করার বিষয়ে তারা উচ্চকণ্ঠ। তারা বলছেন, এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন কষ্টের মধ্যে পড়বে। এতে সরকারের একটি ভুল ম্যাসেজ তাদের কাছে পৌঁছবে। সরকারের ভাবমর্যাদাও বিনষ্ট হবে। সংসদে যখন এ নিয়ে তীব্র আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে, তখন অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করা হবে না। অর্থমন্ত্রীর এমন কঠোর অবস্থান কেন, তা বোধগম্য নয়।
এবারের বাজেটকে সংসদের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের পকেট কাটার বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তারা একে গণবিরোধী বাজেটও বলেছে। অতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্স ও আবগারি শুল্ক ধার্য করে জনসাধারণের পকেট থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মহাপরিকল্পনার বাজেট বলেও বর্ণনা করেছে। দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরাও এ বাজেটের বেশিরভাগ দিক যে নেতিবাচক তা তুলে ধরেছেন। এখন সংসদে এ নিয়ে সংসদ সদস্যরা সোচ্চার। তাদের বেশিরভাগেরই বক্তব্য, ভ্যাট-ট্যাক্স ও আবগারি শুল্ক ধার্য করে সাধারণ মানুষকে কষ্টের মধ্যে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাবে, ব্যাংকে আমানতকারীরা যে অর্থ আমানত হিসেবে রাখবে আবগারি শুল্ক ও ট্যাক্সের কারণে তা কমে লোকসানের মুখোমুখি হবে। এতে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরূপ ধারণা জন্মাবে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাÐের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠবে। সংসদ সদস্যাদের অনেকেই ভ্যাট কমানো এবং আবগারি শুল্ক আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী তাদের এ কথায় কোনো কর্ণপাত না করে বলেছেন, ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করা হবে না। অথচ বাজেট ঘোষণার আগে ১৫ পার্সেন্ট ভ্যাট আরোপের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, তা কমানোর বিষয় বিবেচনা করা হবে। ব্যবসায়ীরা দাবী করেছিলেন তা যেন ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। বাজেট ঘোষণার পর দেখা গেল অর্থমন্ত্রী তার কথায় ঠিক থাকেননি। তিনি ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধার্য করেছেন। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সরকারও সামলোচনার মুখোমুখি হয়েছে। এই ভ্যাট আরোপের কারণে যে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, তা একপ্রকার নিশ্চিত। ইতোমধ্যে তার প্রভাব বাজারে পড়তে শুরু করেছে। যতই দিন যাবে এর কুফল জনগণের উপর তীব্র হতে থাকবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, নতুন করে এই ভ্যাট ও ট্যাক্স বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার যে জনগণের পকেট থেকে অর্থ বের করে নিতে চায়, এ অভিযোগ এখন বাস্তব রূপ লাভ করেছে। সরকারের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, কীভাবে কোন ছুঁতোয় এবং কতভাবে জনসাধারণের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা যায়। সরকার রাজস্ব আদায় করবে এতে কেউ নিষেধ করছে না। তবে রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে জনগণকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দেয়াও সরকারের কাজ নয়। দেখা যাচ্ছে, ভ্যাট-ট্যাক্সের অতিরিক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার জনগণকে চেপে ধরে অর্থ আদায় করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করে চলেছে। শুধু তাই নয়, যেসব মানুষ ব্যাংকে আমানত রেখে তার সামান্য লাভ দিয়ে জীবনের প্রয়োজন মিটাতো, সেখানেও অর্থমন্ত্রী হাত দিয়ে বসেছেন। আমানতের উপর আবগারি শুল্ক এক লাফে ৮০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই আবগারি শুল্কের সাথে লাভের উপর ট্যাক্স, ব্যাংক সার্ভিস চার্জ ও অন্যান্য চার্জ যুক্ত হয়ে আমানতকারির এক লাখ টাকা কমে সাড়ে ৯৬ হাজার টাকায় এসে দাঁড়াবে। অর্থাৎ আমানতকারী মূল টাকাটাই পাবে না লাভ তো পরের কথা। এ প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের হতাশ ও ক্ষুদ্ধ হওয়া কি অস্বাভাবিক নয়!
বাজেটে বিতর্কিত প্রস্তাবগুলো সংশোধনে অর্থমন্ত্রী কেন অটল-অবিচল হয়ে রয়েছেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। যেখানে সব শ্রেণী-পেশার মানুষসহ সংসদ সদস্যরা প্রস্তাবগুলো পুনর্বিবেচনা ও প্রত্যারের দাবী করছেন, সেখানে অর্থমন্ত্রীকে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। ভ্যাট-ট্যাক্স ও আবগারি শুল্ক আরোপের বিরোধিতা কেউ করছে না, তবে প্রত্যেকেরই দাবী, তা সহনীয় করে বাস্তবায়ন করা হোক। আমরা লক্ষ্য করেছি, সরকারের মধ্যে এমন একটা প্রবণতা বিদ্যমান যে, সেবাসহ যে কোনো খাতে দাম বা শুল্ক বৃদ্ধি একেবারে দ্বিগুণ বা তারও বেশি করে ফেলে। সরকার এ বিবেচনা করে না, একবারে যদি কোনো কিছু দ্বিগুণ করে ফেলা হয়, তবে তা সহ্য করার সক্ষমতা মানুষের রয়েছে কিনা। দেখা যাচ্ছে, সরকার মানুষের এ অসুবিধার বিষয়টি মোটেও আমলে নেয় না। দাম বৃদ্ধির দরকার বৃদ্ধি করে দিয়েছে। মানুষ অসুবিধায় পড়ল কি পড়ল না, তার কষ্ট হবে কি হবে না, কোথা থেকে অতিরিক্ত অর্থ দেবেÑএর কোনো কিছুই সরকার বিবেচনায় নেয় না। বাজেটে ভ্যাট-ট্যাক্স ও আবগারি শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমরা মনে করি, সরকার রাজস্ব যেমন আদায় করবে তেমনি এই রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে মানুষের যাতে অসুবিধা না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখবে। রাজস্ব আদায় করার মাধ্যমে তাদের কষ্টের মধ্যে ফেলা সরকারের কাজ হতে পারে না। এতে সরকারের ভাবমর্যাদাও ক্ষুন্ন হয়। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে সর্বস্তরে ভ্যাট-ট্যাক্স ও আবগারি শুল্ক কমানো এবং প্রত্যাহারের যে দাবী উঠেছে, অর্থমন্ত্রী ও সরকারকে তা গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন