রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে অহেতুক বিতর্ক

প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইসলাম প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম, এটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি মীমাংসিত বিষয় হিসেবে পরিগণিত। সম্প্রতি এ নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। ২৮ বছর আগে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে যে রিট মামলাটি দায়ের করা হয় তার চূড়ান্ত শুনানির জন্য প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। প্রধান বিচারপতি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছেন। ২৯ ফেব্রুয়ারি মামলাটি চূড়ান্ত শুনানির জন্য আদালতে ওঠে এবং আদালত শুনানির জন্য ২৭ মার্চ দিন ধার্য করেছেন। এই  প্রেক্ষাপটেই বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৮৮ সালের ৫ জুন চতুর্থ জাতীয় সংসদে সংবিধানের যে অষ্টম সংশোধনী পাস হয় সেই সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২-এর পর যুক্ত হয় ২(ক) যাতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম। তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন  করা যাইবে।’ ওই বছরই এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক রিট মামলা দায়ের করেন। আবেদনে তারা বলেন, বাংলাদেশে নানা ধর্মবিশ্বাসের মানুষ বাস করে। এটি সংবিধানের মূল স্তম্ভে বলা হয়েছে। এখানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে অন্যান্য ধর্মকে বাদ দেয়া হয়েছে। এটি বাংলাদেশের অভিন্ন জাতীয় চরিত্রের প্রতি ধ্বংসাত্মক। তাদের এই বক্তব্য কতটা নৈতিক, গণতান্ত্রিক ও বাস্তবসম্মত তা নিয়ে তখনই প্রশ্ন ওঠে। যা হোক, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন সংবিধান সংশোধনে যে বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয় সেই কমিটি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখার সুপারিশ করে। এই সুপারিশ মোতাবেক সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা হয়। পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মকেও সমান মর্যাদা ও অবস্থান দেয়ার কথা সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়। এর প্রেক্ষিতে রিট মামলা দায়েরকারীদের পক্ষে এটি সম্পূরক আবেদন দাখিল করা হয় যাতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী বলে উল্লেখ করা হয়।
শুরুতেই আমরা উল্লেখ করেছি, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি মীমাংসিত বিষয় হিসেবেই পরিগণিত। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এ ব্যাপারে একটি ঐকমত্য রয়েছে। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দান ও সংবিধানভুক্তকরণ নৈতিক, গণতান্ত্রিক ও বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থিত ও যথাযথ। এ নিয়ে নতুন করে যখন আলোচনা শুরু হয়েছে এবং কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম  নাও থাকতে পারে তখন জনগণ পর্যায়ে বিচলন দেখা দেয়া  অস্বাভাবিক নয়। প্রসঙ্গটি আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, ইসলামের রাষ্ট্রধর্ম না-ও রাখতে পারে বাংলাদেশে। যুক্তি দেখানো হচ্ছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হালের কয়েকটি হামলার প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। এ ধরনের বক্তব্য কল্পনাপ্রসূত ও অনেকটাই প্ররোচণামূলক। এখন যারা ক্ষমতায় তাদের কেউই আভাসে-ইঙ্গিতে এমন কথা বলেননি যে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে কিংবা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কারণেই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার যে প্রসঙ্গ সামনে আনা হচ্ছে, তা সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের অংশমাত্র। সংখ্যালঘু হিন্দু বা অন্যরা যেমন হামলার শিকার হয়েছে, তেমনি মুসলমানরাও হামলার শিকার হয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কারণে এসব হামলা হয়েছে, সেটা বলা যায় না। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক দেশ। এখানে শত শত বছর ধরে বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ অত্যন্ত সম্প্রীতি, শান্তি ও নিরাপত্তাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছে। ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলেও এখানে অন্যান্য ধর্মের লোকেরা মানবিক ও সাংবিধানিক সকল অধিকার সমানভাবে ভোগ করছে। বলা যায়, বাংলাদেশই বিশ্বে একমাত্র দেশ যেখানে সংখ্যালঘুরা সবচেয়ে নিরাপদ ও ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা শতকরা ৭ জন। অথচ তারা প্রশাসন, পুলিশ, ব্যাংকিং সেক্টর, শিল্প-সংস্কৃতি, বেসরকারি চাকরি-বাকরি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই আনুপাতিক সংখ্যার চেয়ে বহুগুণ বেশি সংখ্যায় কর্মরত রয়েছে। বহু উচ্চপদে তারা দায়িত্ব পালন করছে। জনসংখ্যার বিবেচনায় সংখ্যাগুরু মুসলমানরা বঞ্চিত হলেও তাদের কোনো ক্ষোভ-অসন্তোষ নেই। এ রকম একটি দেশ কি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে! মুসলমানদের এই যে অসাম্প্রদায়িক ও সমঅধিকার চিন্তা বা বোধের মূলে রয়েছে ইসলাম। ইসলামের মহান শিক্ষাই তাদের অসাম্প্রদায়িক, সহনশীল, দায়িত্বশীল ও সহৃদয় করেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলমানরা সব দেশে সব সময়ই প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের প্রতি সদাচার প্রদর্শন করে আসছে। সংখ্যালঘু হিসেবে মুসলমানরা প্রায় ৮শ’ বছর ভারত শাসন করেছে। ঐতিহাসিকরা বলেছেন, মুসলমান শাসকরা যদি চাইতেন, তাহলে সবাইকে জোর করে মুসলমান বানাতে পারতেন। সেটা হলে এখন আর ভারতে মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। যে ইসলাম সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোককে এমন নিরাপত্তা দেয় সেই ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলে অন্যান্য সম্প্রদায়ের বরং খুশি হওয়ার কথা, বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা নয়।
ইতোমধ্যে আওয়ামী ওলামা লীগসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের তরফ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আওয়ামী ওলামা লীগের পক্ষে বলা হয়েছে, যারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরোধিতা করবে, তারা সংবিধানবিরোধী বলে চিহ্নিত হবে। বলা হয়েছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিষয়ে সরকার বিরূপ চিন্তা করলে তা সরকারের জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ হবে। হেফাজতে ইসলামের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করা হলে প্রতিরোধের দাবানল জ্বলে উঠবে। বিবৃতিতে অবিলম্বে হাইকোর্টে দায়ের করা রিট মামলা প্রত্যাহার বা বাতিল করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। মহামান্য আদালতের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছে, জনস্বার্থ, সংখাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় চেতনা সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে এ ধরনের বিতর্কিত বিষয়ে দায়ের করা রিট খারিজ করে দেয়া হোক। এ ব্যাপারে সরকার ও সরকারি দলকে সার্বিক দিকের বিবেচনায় ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এমনিতেই সরকারের প্রতি নানা বিষয়ে জনগণের ক্ষোভ রয়েছে। বিশেষ করে তার ‘ভারতনীতি’ একেবারেই পছন্দ করছে না মানুষ। এমতাবস্থায় সরকার যদি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে দেয়, যার সব ক্ষমতাই সরকারের রয়েছে, তাহলে জনগণ পর্যায়ে প্রচ- বিক্ষোভ উত্থিত হবে। আমরা আশা করব, সরকার এ ক্ষেত্রে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে। উদ্ভূত বিতর্ক অবসানে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে। 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন