ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না। সড়ক-মহাসড়কে যানজটে আটকে পড়া যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা। অধৈর্য্য গাড়ি চালকদের বেপরোয়া আচরণে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি। এসব ঘটনা প্রতি বছরই ঘটে চলেছে। ঈদ সামনে রেখে এবারও এ চিত্রের কোনোরূপ ব্যতিক্রম হবে না বলে আগাম ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। প্রতিকারে কতটুকু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তা এখনও জানা যায়নি। তবে ঘরমুখো মানুষ প্রিয়জনদের সাথে ঈদ করতে আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়েছে। আগাম বাস- ট্রেনের টিকেট কেটে রেখেছে। এখন শুধু পরিবার-পরিজন নিয়ে যানবাহনে চড়ে বসার অপেক্ষা। ঈদে বাড়তি যাত্রী পরিবহনের জন্য পরিবহন সংস্থাগুলোও বসে নেই। পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা ও আনফিট গাড়ি কোনো রকমে মেরামত এবং রং করে রাস্তায় নামানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। নৌ পথে পুরনো আনফিট লঞ্চ রং করে নামানোর কাজ শুরু হয়েছে। যানবাহনের এ ধরনের আয়োজন ঘরমুখো মানুষের যাত্রাকে শংকিত করার জন্য যথেষ্ট। নৌপথে মাওয়াসহ কিছু ঘাটে প্রভাবশালীদের কারণে যাত্রী পরিবহনে অনিয়মের কাছে খোদ নৌমন্ত্রী অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী প্রতিদিনই বলছেন, সড়ক পথে কোনো সমস্যা হবে না। তাদের অসহায়ত্ব ও ঘোষণার মধ্যেও যে চিত্র বরাবরের মতো ফুটে উঠেছে, তাতে ঘরমুখো মানুষের যে অশেষ দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
ধারণা করা হচ্ছে, এবার ঈদে ৮০ লাখ লোক রাজধানী ছাড়বে। রাজধানীর আশপাশের গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ প্রায় সোয়া কোটি মানুষ ঈদ করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে রওনা দেবে। তাদের এই যাত্রা শুরু হতে পারে আগামী বৃহস্পতিবার থেকে। এ যাত্রা এমন সময় শুরু হচ্ছে যখন ভরা বর্ষা। গত বছরের মতো এবারও বর্ষায় ঈদ হচ্ছে। আশঙ্কাটা এখানেই। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষের যাত্রা কতটা নির্বিঘœ হবে, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ অমূলক নয়। এমনিতেই ঈদের সময় সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের বাড়তি চাপ থাকে। ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা এলোমেলো হয়ে যায়। তার উপর রয়েছে মহাসড়কের বেহাল দশা। মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঢলে দেশের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এসব রাস্তাঘাট মেরামত ও চলাচল উপযোগী না করলে যাত্রীদের অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এদিকে খবর প্রকাশিত হয়েছে, মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো পয়েন্ট সংস্কার না করায় যানজটসহ দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকা হয়ে রয়েছে। রাস্তার উপর বাজার বসা, নসিমন, করিমন ও ভটভটির মতো থ্রি হুইলার চলাচল, অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক, রাস্তার তুলনায় সরু সেতু যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচলে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-আরিচা-খুলনা মহাসড়কের কথা যদি ধরা হয় তবে দেখা যাবে, এসব মহাসড়কে মসৃনভাবে চলাচলের কোনো উপায় নেই। অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে বিবেচিত আট লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রয়েছে জায়গায় জায়গায় যানজট সৃষ্টির কারণ। এক কাঁচপুর ব্রিজের কাছেই যে জ্যাম লাগে, তাতেই ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যায়। এর মূল কারণ সড়ক আট লেন হলেও ব্রিজটি আট লেনের উপযোগী নয়। চওড়া সড়ক ব্রিজের কাছে গিয়ে সরু হয়ে পড়েছে, যাকে বলে বোটল নেক। এতে এক সাথে সব যানবাহন সেখানে গিয়ে আটকে পড়ে। এছাড়া মহাসড়ক জুড়ে যেমন সংযোগ সড়ক রয়েছে, তেমনি বাজারও বসছে। এরকম পরিস্থিতি অন্য মহাসড়কগুলোতেও রয়েছে। মহাসড়ক বলতে সাধারণত সেসব সড়ককে বোঝায়, যেসব সড়কের সাথে অন্য কোনো আন্তঃসংযোগকারী সড়ক বা ফিডার রোড যুক্ত হবে না। মহাসড়ক থাকবে নিট অ্যান্ড ক্লিন। বাংলাদেশে এ ধরনের একটি মহাসড়কও নেই। প্রতিটি মহাসড়কের সাথেই সংযোগ সড়ক তো রয়েছেই, এমনকি সড়কের উপর অবৈধভাবে বাজার বসছে। এই বাজার বসার কারণে কত যে দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। অবৈধ এসব বাজার যেন একেকটি মৃত্যু ফাঁদ হয়ে রয়েছে। এর উপর জায়গায় জায়গায় ভাঙাচোরা ও বড় বড় গর্ত রয়েছে। এগুলোও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। আমরা দেখেছি, কেবল ঈদ এলেই সড়ক-মহাসড়কে সংস্কার কাজ শুরু হয়। এসব সংস্কার এমনই দুর্বল যে সংস্কার করতে না করতেই বৃষ্টির পানি ও গাড়ি চলাচলের কারণে নষ্ট হয়ে যায়। গত বছর এ চিত্র আমরা দেখেছি। নৌপথের যাত্রায়ও শঙ্কা রয়েছে। ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম হওয়ায় ঝুঁকি থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে এ ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে আনফিট লঞ্চ নতুন করে নামানোর কারণে। দেখা যায়, ঈদের মৌসুম এলেই এসব অনুপযুক্ত ভেসেল যানবাহনের বহরে যুক্ত হয়। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে ‘দুর্ঘটনায় কারো হাত নেই’ এমন অজুহাত দেখিয়ে দায় এড়িয়ে যাওয়া হয়।
মানুষ আপনজনদের সাথে ঈদ করতে যাবে, এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। এ সময় ঘরমুখো মানুষের বাড়তি চাপ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, সড়ক-মহাসড়কের যে অব্যবস্থাপনা তা মানুষের ঈদ আনন্দযাত্রাকে ¤øান করে দেয়। এমনও দেখা গেছে, যানজটের কারণে ঈদের আগের দিন যাত্রা করে ঈদের দিনও পৌঁছতে পারেনি। ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে আটকে পড়ে মানুষের ঈদ আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, সড়ক পথে শতকরা ৫৫ ভাগ মানুষ যাতায়াত করে। ট্রেনে করে ২০ ভাগ এবং নৌপথে ২৫ ভাগ। দেখা যাচ্ছে, সড়কের উপরই যাত্রীদের চাপ বেশি। এ হিসাব নিশ্চয়ই সড়ক ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িতরা জানেন। কাজেই এটা বুঝেই তাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। ঈদ সামনে রেখে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরী। দক্ষ ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা, সড়ক নির্বিঘœ করতে অবৈধ স্থাপনা ও বাজার উচ্ছেদ থেকে শুরু করে ফিডার রাস্তাগুলো বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। জেলাভিত্তিক মহাসড়ক নির্ঝঞ্ঝাট রাখতে স্থানীয় প্রশাসনকে অধিক তৎপর হতে হবে। মহাসড়কগুলোর মাঝে যেসব গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও সেতু রয়েছে, সেগুলো সংস্কার করে চলাচল নির্বিঘ করতে হবে। ঈদ সামনে রেখে যেসব আনফিট গাড়ি ও লঞ্চ নামানো হয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের আনন্দযাত্রা যাতে নিরাপদ ও আনন্দদায়ক হয় এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন