ইনকিলাব ডেস্ক : কাতারের মিডিয়া আল-জাজিরা বন্ধে সউদী জোটের শর্ত নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এ দাবি মিডিয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভয়াবহ হুমকি। অবরোধ প্রত্যাহারে কাতারকে সউদী জোট আল-জাজিরা বন্ধের যে শর্ত দিয়েছে, তাকে ‘মিডিয়ার বহুমুখী কণ্ঠস্বরের প্রতি আঘাত’ অভিহিত করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ জুন জঙ্গিবাদে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয় মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ। ২৩ জুন সউদী নেতৃত্বাধীন চার আরব দেশের পক্ষ থেকে অবরোধ প্রত্যাহারে ১৩টি শর্ত দেওয়া হয় কাতারকে। এর একটি শর্ত হলো আল-জাজিরা বন্ধ করে দেওয়া।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধীনে যে বিশেষজ্ঞরা কাজ করেন তারা সংস্থাটির বেতনভোগী নন। স্বাধীনভাবে তারা জাতিসংঘ-দূত হিসেবে কাজ করে থাকেন। এখন সংস্থাটির মত প্রকাশ ও বাকস্বাধীনতা বিষয়ক দূত হিসেবে কাজ করছেন ডেভিড কায়ি। এক বিবৃতিতে তিনি আল-জাজিরা বন্ধের শর্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ডেভিড কায়ি বলেছেন, কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি বন্ধের শর্ত ‘মিডিয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভয়াবহ হুমকি’। তিনি ‘আল-জাজিরা বন্ধের দাবি থেকে সউদী জোটকে সরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে চাপ প্রয়োগের আহŸান জানান। আরব দুনিয়ায় মিডিয়ার ওপর সেন্সরশিপ আরোপের প্রচেষ্টা রুখে দেওয়া এবং সেখানে স্বাধীন মিডিয়া উদ্যোগকে উৎসাহিত করারও তাগিদ দিয়েছেন কায়ি।
আল জাজিরা বিশ্বের প্রভাবশালী প্রধান ধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর একটি। কাতার ও প্রতিবেশী দেশগুলোর দীর্ঘদিনের বিবাদের উৎস এটি। সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অভিযোগ, আল জাজিরা পক্ষপাতপূর্ণ সংবাদ উপস্থাপন করে এবং আঞ্চলিকভাবে সমস্যা তৈরি করে। এছাড়া এ সংবাদমাধ্যমটি আরব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়েও নাক গলায় বলে অভিযোগ করে থাকে তারা। অবশ্য, বরাবরই সেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে আলজাজিরা।
‘আরব দুনিয়ার ভিন্নমত রুখতেই আল-জাজিরা বন্ধের প্রচেষ্টা’
এদিকে জাতিসংঘের পাশাপাশি প্রধান ধারার ৮০টিরও বেশি সংবাদমাধ্যম অবস্থান নিয়েছে কাতারভিত্তিক ওই সংবাদমাধ্যমের পক্ষে। মানবাধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় সোচ্চার সংগঠনগুলোও সরব হয়েছে ওই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। সরব হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকা মুক্তমতের পক্ষের মানুষেরা। আল-জাজিরার স¤প্রচার হুমকির মুখে পড়াকে তারা সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত হিসেবে দেখছেন। একে আরব দুনিয়ার সংবাদের বৈচিত্র্য ও ভিন্নমত দমনের চেষ্টা বলেও অভিহিত করেছেন তারা।
আরব দুনিয়ার পরাধীন সংবাদমাধ্যমের বাস্তবতায় ১৯৯৬ সালে আল জাজিরার আবির্ভাব। কাতারের অর্থায়নে পরিচালিত এই সংবাদমাধ্যমটি রাষ্ট্রীয় গণসংযোগের বিপরীতে জনগুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশ করতে থাকে জন্মলগ্ন থেকে। একমাত্র কাতার ছাড়া গোটা আরব বিশ্বের স্বৈরশাসকদের তারা উন্মোচিত করেন জনতার সামনে। ২০০১ সালেই বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সংবাদমাধ্যমটি। ওয়াশিংটন পোস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সউদী নেতৃত্বাধীন আরব জগতে সংবাদমাধ্যমে যে একমুখী কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতো, আল-জাজিরা সেই অচলায়তন ভেঙে নিয়ে ভিন্ন ধারায় খবর পরিবেশনের মধ্য দিয়ে জনপ্রিয় হতে থাকে। ইসলামী শরীয়াকে আলোচনায় নিয়ে আসে সংবাদমাধ্যমটি। যেটা আরব দুনিয়ার অন্যান্য মিডিয়ায় আগে কখনও আলোচিত হয়নি।
অবরোধ প্রত্যাহারে কাতারকে সউদী জোট আল-জাজিরা বন্ধের যে শর্ত দিয়েছে, তাকে ‘মিডিয়ার বহুমুখী ও অন্য কণ্ঠস্বরের প্রতি আঘাত’ হিসেবে দেখছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। সরব হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলোর জোট ডিজিটাল কনটেন্ট নেক্সট। বিবিসি, গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্টের মতো শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলো ওই জোটভুক্ত। ফক্স নিউজ, এবিসি নিউজ, আল-জাজিরা, বøুমবার্গ, বিজনেস ইনসাইডার, সিএনবিসি, ডিসকোভারি, ফোর্বস, ইসপিএন, ফরেন পলিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, এনপিআর, সেøট, ইউএসএ টুডের মতো শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলোও রয়েছে ওই সংগঠনে।
সোমবার এক বিবৃতির মাধ্যমে ডিজিটাল কনটেন্ট নেক্সট আল-জাজিরার প্রতি সংহতি প্রকাশ করে। সউদী জোটের ভূমিকাকে আজ-জাজিরার কণ্ঠরোধের মধ্যে দিয়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের পাঁয়তারা চলছে বলে মনে করছে তারা। বিবৃতিতে তারা জানায়, ‘আমরা সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকের স্বাধীনতাকে সমর্থন করি। সাংবাদিক বা সংবামাধ্যমের কণ্ঠরুদ্ধ করা এর পরিপন্থী।’
আল-জাজিরার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে ইরাক যুদ্ধের সময়ে। সেই সময় বিবিসি ও সিএনএন-এর মতো পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো যখন মিথ্যা খবর পরিবেশনে অভিযুক্ত হয়েছে বিশ্বজুড়ে, বিশ্ববাসী তখন আল-জাজিরায় চোখ রেখেছে প্রকৃত ঘটনা জানতে। এর কণ্ঠরোধের অপচেষ্টায় উদ্বেগ জানিয়েছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় সোচ্চার অলাভজনক সংগঠন রিপোটার্স উইদাউথ দ্য বর্ডার। কাতারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে দেওয়া সউদী জোটের শর্ত নিয়ে বলতে গিয়ে ওই সংগঠনের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক প্রধান আলেকসান্দ্রা এল খাজেন বলেন, ‘যদি শর্ত পূরণ করতে সত্যিই আল-জাজিরা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবে তা হবে ভীষণ উদ্বেগজনক। প্যারিস থেকে তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আরব দুনিয়ার মিডিয়ায় বৈচিত্র্য ও বহুস্বর রক্ষার বিপরীতে সেন্সরশিপসহ যাবতীয় প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে আমরা।’
প্রতিবাদে সামিল হয়েছে যুক্তরাজ্যের সাংবাদিকদের সংগঠন ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট টিম ডাওসন আল-জাজিরা বন্ধের প্রস্তাবকে সউদী জোটের ‘ভয়াবহ দাবি’ বলে উল্লেখ করেছেন। সউদী সরকারকে তিনি এই দাবি থেকে সরে আসার আহŸান জানান।
আল-জাজিরার প্রতি সউদী জোটের নাখোশ হওয়ার আরেক কারণ আরব বসন্ত। আরব জাগরণে আল-জাজিরার প্রশ্নাতীত ভূমিকা সউদী জোটে থাকা স্বৈরাচারী সরকারগুলোকে ভীত করে তোলে। পাশাপাশি মিসরের স্বৈরতন্ত্রের পতন এবং মুহাম্মদ মুরসির ব্রাদারহুডের উত্থানের নেপথ্যে আল-জাজিরাকে দায়ী করা হয়। সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট-সিপিজে আল-জাজিরার বিরুদ্ধের পদক্ষেপকে ‘ভিন্নমত দমনের অপচেষ্টা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ‘আল-জাজিরাকে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতির বলি বানানো’ হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত সব দেশের প্রতি তারা আহŸান জানিয়েছেন, সংবাদমাধ্যমের প্রতি বৈরী অবস্থান থেকে সরে আসতে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে আল-জাজিরার বিরুদ্ধে আনা সউদী জোটের অভিযোগকে বানোয়াট আখ্যা দিয়েছে। সংস্থার মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক সারাহ হুইটসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এটা নিছক দুর্বলচিত্তের এক সেন্সরশিপের বিস্তৃতি, নিজ নিজ দেশের জনগণের ওপর যা আরোপ করে রেখেছে সউদী জোটে থাকা দেশগুলো।’
প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান তাদের এক সম্পাদকীয় ভাষ্যে আল-জাজিরা বন্ধের প্রস্তাবের নিন্দা জানিয়েছে। তাদের মতে, পুরনো ধারার একমুখী আরবীয় স্বরের বিপরীতে আল-জাজিরা ভিন্ন স্বর নিয়ে হাজির হওয়া এক মিডিয়া। আর নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সম্পাদনা পরিষদের পক্ষ থেকে লেখা এক মতামতে বলা হয়েছে, ‘আল-জাজিরা বন্ধের পায়তারা একটি জোরালো কণ্ঠস্বরকে দমন করবার প্রচেষ্টা, যা জনগণকে ক্ষমতাসীনদের প্রতি প্রশ্নমুখর করে তুলতে পারে’। সূত্র : ওয়েবসাইট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন