বর্ষার আগেই প্রচুর বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে নেমে আসা বিপুল পানিরাশি যখন হাওর এলাকা ডুবিয়ে দেয় এবং উঠতি বোরো ধানের ব্যাপক বিনাশ সাধন করে তখনই আশংকা করা হয়েছিল, এবার বর্ষায় সারাদেশ বন্যার কবলে পড়তে পারে। সেই বন্যা ফসলহানি, সম্পদ-সম্পত্তির ক্ষতি এবং জনদুর্ভোকে নিয়ে যেতে পারে চরমে। বর্ষার শুরুতেই সেই আশংকা বাস্তব রূপ নিতে শুরু করেছে। হাওর-বিপর্যয়ের দু’মাস পর মৌলভীবাজার ও সিলেট এখন বানের পানিতে ভাসছে। অবিরাম বর্ষন ও সীমান্তের ওপার থেকে আসা ঢলে ওই দুই জেলার অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে। ফসলাদিসহ বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। জেলা সদরের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দুই জেলায় পানি বন্দিত্বের শিকারে পরিণত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। বন্যা কবলিত মানুষের আশ্রয়ের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কয়েকশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুরমা-কুশিয়ারাসহ সকল নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায়, বন্যা পরিস্থিতির আরো বিস্তৃতি ও অবনতি ঘটতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, চলতি মাসে মওসুমী বায়ুর সক্রিয় প্রভাবে দেশজুড়ে ভারি ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। সেই সঙ্গে ভারতে থেকে ঢল নেমে এলে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটতে পারে। আলামত থেকে সেটাই এখন প্রতীয়মান হচ্ছে। দেশের প্রায় সর্বত্র প্রতিদিন কম-বেশী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ওদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মেঘালয়ে প্রবল বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। ফলে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের মাত্রাও ক্রমাগত বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যকেন্দ্র সূত্রের মতে, দেশের বিভিন্ন নদনদীর পানি একযোগে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৯০টি পয়েন্টের পর্যবেক্ষণে ৪৫টিতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারায় ৫টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মায় পানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। পরিস্থিতির এই প্রেক্ষাপটে দেশব্যাপী শংকা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা কি আছে? হাওর এলাকায় আকস্মিক ও অকাল বন্যায় ৯০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়েছে। লাখ লাখ কৃষক পরিবার সম্পূর্ণ নি:স্ব ও অসহায় হয়ে পড়েছে। তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্তৃপক্ষসমূহ হাওর এলাকায় বন্যা রোধ করতে পারেনি, ফসল রক্ষা করতে পারেনি এবং দুর্গত মানুষের সহায়তায় দ্রুত এগিয়ে যেতে পারেনি। এখন দেশের বিশাল এলাকায় বন্যা দেখা দিলে একযোগে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা নি:সন্দেহে কঠিন হয়ে পড়বে। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা থাকলে ফসল, ঘরবাড়ি স্থাপনা যতটা সম্ভব রক্ষা, পানিবন্দী মানুষ উদ্ধার, আশ্রয় দান, ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা ইত্যাদি সহজ হতে পারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এ ব্যাপারে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা কোন পর্যায়ে আছে, আমাদের জানা নেই। আমরা মনে করি, এ সম্পর্কে একটি স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও কার্যব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি ও অভাব থাকলে দ্রুতই তা পূরণ করতে হবে। বিগত কয়েক বছরে বন্যা তেমন কোনো বিপজ্জনক পর্যায়ে যায়নি। ফলে ক্ষতি ও ফসলহানি কম হয়েছে। এবার যেহেতু বড় আকারে বন্যার আশংকা করা হচ্ছে সুতরাং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা, পরিধি ও মানবিক বিপর্যয় বেশী হওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তাই জাতীয়ভাবেই একটা সর্তকতা অবলম্বন করা জরুরি।
বান-বন্যা কেন, যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে সম্পদ-সম্পত্তির অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। সবচেয়ে বিপাকে পড়ে মানুষ। মানবিক দুর্গতি ও বিপর্যয় চরমে ওঠে। গোটা দেশের মানুষের জীবনযাপনে দুর্যোগকালে ও দুর্যোগ পরবর্তীকালে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। হাওরে ফসল হানি ইতোমধ্যেই চালের বাজারে আঘাত হেনেছে। চালের দাম হু হু করে বাড়ছে। সাধারণ, নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের মোটা চাল এখন এক কেজির দাম ৫০ টাকার ওপরে। চিকন চালের দামও ৭০ টাকার কাছাকাছি। চালের দামের সঙ্গে অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামও ক্রমবর্ধমান। চালের দাম বাড়ার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ না থাকলেও হাওরের ফসলহানি অজুহাতে পরিণত হয়েছে। সরকার খাদ্যশস্যের কোনো সংকট নেই বলে দাবি করলেও এবং নতুন করে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও বাজারে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, অসৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে চালের দাম বাড়ছে। অথচ সেই কারসাজি ভাঙ্গার কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। আগামীতে বন্যার বিস্তার ঘটলে চালের দাম আরও বাড়বে, অন্যান্য নিত্য পণ্যের দামও বাড়বে, এটা অনুমান করা যায়। প্রতিবেশীর ঘরের আগুনে আলু পুড়িয়ে খাওয়ার মানুষ আমাদের দেশে কম নেই। মানুষের দুর্দিনকে পুঁজি করে লাভের কড়ি হাতানোর চরিত্র যাদের, তাদের দৌরাত্ম রোধের উপায় কি? সেটা এখন থেকেই ভাবা দরকার। খাদ্য ও নিত্যপণ্যের সংকট ও দাম যাতে না বাড়ে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে এখনই তৎপর হতে হবে। বন্যা হোক এবং সে কারণে মানুষের দুর্ভোগ, কষ্ট ও যাতনা বাড়–ক, এটা কারো কাম্য নয়। তবে বাস্তব হলে জনস্বার্থে তা মোকাবিলার সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। সরকার ও প্রশাসন এ বিষয়ে উচ্চ সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন