সাংগঠনিক চাঁদাবাজিতে বিপর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলার সাধারন পাহাড়ী-বাঙালীর জীবন
সাখাওয়াত হোসেন : সীমান্তের ওপারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর হাত ঘুরে ভারি অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরক মজুদ বাড়াচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। অবৈধ অস্ত্রের কারনে পাহাড়ীগ্রুপগুলোর কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়ে আছে পাহাড়ে বসবাসরত সাধারন বাঙালি-পাহাড়ী পরিবারগুলো। আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের সাংগঠনিক চাঁদাবাজিতে বিপর্যন্ত রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার লাখ লাখ মানুষের জীবন। বছরে শত শত কোটি টাকার চাঁদা আদায় করছে জেএসএস, জেএসএস (সংস্কার) ও ইউপিডিএফ-এর সন্ত্রাসীরা। ভ্যাট ও ট্যাক্সের আদলে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের চাঁদা আদায় থেকে রক্ষা পাচ্ছে না ছোট ছোট ব্যবসায়ীরারও। চাঁদা না পেলে মারধর, গুলি, অপহরণ এমনকি খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। যে এলাকায় যে সংগঠনের আধিপত্য বেশি সেখানে সেই সংগঠন চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে কিছু কিছু এলাকায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মাঝে মাঝে ধরা পড়লেও কৌশল পাল্টে তারা সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রাখছে। নিরাপত্তার অজুহাতে চাঁদাবাজির শিকার ব্যক্তিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ জানায় না। পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলো নিজেদের প্রভাবিত এলাকায় স্থানীয় বাজার, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও চাঁদা আদায় করে। বিভিন্ন ফসল, ফল-ফলাদি, গবাদিপশু বেচাকেনায়ও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। চাকরিজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে চিঠি দিয়ে। এখন চলছে ফলের মৌসুম। পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত আম, কাঁঠাল, আনারসসহ বিভিন্ন ফলের শত শত ট্রাক থেকে এলাকাভেদে বিভিন্ন হারে চাঁদা আদায় করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা ক্যাম্প কমে যাওয়ায় চাঁদাবাজিসহ পাহাড়ে নানা অপরাধ বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাহাড়েরর একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জুমল্যান্ড ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার কথিত দাবি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর সামরিক উইং বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও প্রকারান্তরে অঘোষিতভাবে এদের একটি অংশের কাছে ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়ে যায়। এর পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করছে। নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অভিযানে দফায় দফায় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হলেও তা সামান্য। অধিকাংশ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আসছে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী একাধিক গ্রুপের কাছ থেকে। পাহাড়ী-বাঙালী এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদেরও অস্ত্রধারীদের হাতে অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছেন। সূত্র জানায়, শান্তিচুক্তির পর জনসংহতি সমিতির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে শন্তু লারমা খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তার বাহিনীর বিপুল সদস্যদের নিয়ে অস্ত্রসমেত আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু একটি অংশ এর বিরোধিতায় ছিল। পরবর্তীতে তারা শন্তু লারমাকে বেইমান আখ্যায়িত করে প্রতিষ্ঠা করে ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট)। এ গ্রুপের হাতে রয়ে যায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ। সরকার পক্ষে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী একে একে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। প্রধান সমস্যাটি রয়ে গেছে ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ। এ বিরোধ নিয়ে সরকার নিয়োজিত একটি কমিশন তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। পাহাড়ী-বাঙালীদের মাঝে ভূমির বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন। পাহাড়ীরা মনে করেন, পাহাড়জুড়ে ভূমির মালিকানা পাহাড়ীদের। অথচ এই পাহাড়ে যুগের পর যুগ ধরে বাস করে আসা বাঙালীদেরও ভূমির মালিকানা রয়েছে এবং ৮০-র দশকের পর থেকে নতুন করে বাঙালীদের (স্যাটেলার) বসতি গড়ে তোলার পর তাদের কবুলিয়ত (ভূমির মালিকানা) প্রদান করা হয়। বর্তমানে বাঙালীদের সেই ভূমির মালিকানা পাহাড়ীরা মানতে নারাজ। বিশেষ করে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে এ ধরনের সমস্যা ব্যাপক।
অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, শান্তিচুক্তির শর্তাদি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে জনসংহতির মধ্যেই মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। জনসংহতি সমিতি ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় নতুন গ্রুপ। যার নাম জনসংহতি সমিতি সংস্কার। মূল সমিতি সন্তুর নামেই পরিচিতি পেয়ে আসছে। এর পাশাপাশি ইউপিডিএফের বিরোধিতা তো রয়েছেই। শান্তিচুক্তির পর থেকে পাহাড়ে বিভিন্ন সময়ে হত্যা, লুণ্ঠন, জ্বালাও পোড়াও, অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির পরিস্থিতি রয়েছে নজিরবিহীন অবস্থায়। সর্বশেষ গত ২৯ জুন বৃহস্পতিবার ভোরে রাঙ্গামাটির লংগদুতে উদ্ধার করা হয় ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ। সেনা নিয়ন্ত্রণে যৌথবাহিনী পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের এ আস্তানাটিতে অভিযান চালানোর পর একে-৪৭ রাইফেল, সামরিক পোশাকসহ গোলাবারুদ উদ্ধার হওয়ার পর নতুন করে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ছিল বলে তথ্য রয়েছে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। এসব অস্ত্র দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছ থেকে সংগৃহীত হওয়ার পাশাপাশি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এর একটি অংশ সমতলের সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রিও হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থা এবং সিভিল প্রশাসনের কাছে এদের তৎপরতার নানা খবর থাকলেও গভীর অরণ্যাঞ্চল হওয়ায় উদ্ধার অভিযান প্রতিনিয়ত পরিচালনা করা একটি কঠিন ব্যাপার। বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, পাহাড়ের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। পাহাড়ী সংগঠনগুলো যে দাবি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছে তা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী। এরা চায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুমল্যান্ড ঘোষণা করতে হবে। দিতে হবে স্বায়ত্তশাসন। নিজেদের দাবি করে জুম্মজাতি। অথচ দেশের এক-দশমাংশ এ এলাকাটি বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপ নয়। সমতলের সঙ্গে সংযুক্ত অঞ্চল। সেই ব্রিটিশ আমলে ঘোষিত সিএইচটি (চিটাগং হিল ট্যাক্টস)। এ অঞ্চলে বসতির শুরু থেকেই বাঙালীরাও বসতি গড়ে তুলেছে। তবে সংখ্যাধিক্যে পাহাড়ীরা ছিল বেশি। বর্তমানে বাঙালীদের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু এ বাড়তি প্রবণতা পাহাড়ের এসব সংগঠনের কুচক্রী মহলের সহ্য হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্যাপকভাবে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারী কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার পর পাহাড়ে যে উন্নতি এসেছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এরপরও এদের নতুন দাবি জুম্মল্যান্ড ও স্বায়ত্তশাসন।
পাহাড়ের বিভিন্ন সূত্রে তথ্য রয়েছে, যৌথবাহিনী যখনই অভিযান চালায় তখনই তারা সীমান্ত পেরিয়ে অবস্থান নেয়। অভিযান শেষে নিরাপত্তা বাহিনী ফিরে গেলে পুনরায় স্ব স্ব অবস্থানে ফিরে আসে। বর্তমানে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়টি হচ্ছে, ভারি অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলার বিষয়টি। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন উত্তরণ’ অব্যাহত রয়েছে। এ অপারেশনের মূল অর্থই হচ্ছে পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়ন সাধন। যে পাহাড়ের দূরবর্তী অঞ্চলে অতীতে যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না সেখানে এখন সেই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি বিদ্যুত সংযোগও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এক সময় পাহাড়জুড়ে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বন্ধ রাখা হয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার তা তুলে দেয়ার পর পার্বত্যাঞ্চল জুড়ে এখন আধুনিক এ ব্যবস্থার সুবিধাও তারা ভোগ করছে। সূত্র জানায়, গত ৬ জুন চাঁদা দিতে না চাওয়ায় মানিকছড়ি-খাগড়াছড়ি রাস্তার পিছলাতলা এলাকায় কাঁঠাল বোঝাই পিকআপ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। চাঁদা না দেয়ায় স¤প্রতি বিআরটিসির একটি ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। রাঙামাটির এক ব্যবসায়ী বলেন, তারা রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদা চেয়ে না পেলে আগে হয়তো মারধর করে ছেড়ে দিত। এখন গুলি করে দেয়। গাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পার্বত্য এলাকায় গড়ে উঠা ফলদ ও বনজ বাগানের মালিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয় মোটা অংকের চাঁদা। একরপ্রতি এক থেকে দেড় হাজার টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হয়। হাজার হাজার ফলবাগান থেকে চাঁদা আদায় করা হয়। ইতিপূর্বে রাঙামাটির নানিয়ারচর এলাকায় চাঁদার জন্য শত শত একর আনারস বাগান কেটে পুড়িয়ে দেয়া হয়। সূত্র জানায়, প্রতিদিনই পার্বত্য অঞ্চল থেকে পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপগুলো এক থেকে দেড় কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে। বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার চাঁদা আদায় করে তারা। চাঁদা আদায় করে জেএসএস ও ইউপিডিএফের কয়েক হাজার সশস্ত্র কর্মী। আদায় করা চাঁদার টাকা দিয়ে তারা সংগঠনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, দেশ-বিদেশে বাঙালিবিদ্বেষী প্রচারণা ও তাদের অস্ত্র-বিস্ফোরক কেনায় ব্যয় করে।
সূত্র জানায়, একে-৪৭, একে-২২, এম-১৬ রাইফেল, নাইন এমএম পিস্তল, চাইনিজ সাব-মেশিনগানসহ অত্যাধুনিক সব অস্ত্র রয়েছে সংগঠনগুলোর হাতে। ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমার হতে এসব অস্ত্র সংগ্রহ করে তারা। মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি) সহযোগিতায় পাহাড়ি সংগঠনের জন্য অস্ত্রের চালান আসার পথে গত ৯ ডিসেম্বর সে দেশের কারেন প্রদেশে সেগুলো ধরা পড়ে। একইভাবে ভারতের মিজোরামেও একাধিকবার অস্ত্রের চালান ধরা পড়ে।
সূত্র জানায়, নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতায় মাঝে মাঝে অস্ত্রসহ বিভিন্ন গ্রুপ ধরা পড়লেও তাদের বিস্তর সশস্ত্র নেটওয়ার্ক ধরাছোঁয়ার বাইরে। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নকারী বর্তমান সরকারের সহনশীল মনোভাবের কারণেই এখন পার্বত্য এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো কোনো অভিযান নেই। এজন্য সশস্ত্র গ্রুপগুলো নির্বিঘেœ তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। স্থানীয়রা বলেছেন, তিন পার্বত্য জেলায় নির্দিষ্ট বিরতির পর নিয়মিত অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানো হলে পাহাড়ের সন্ত্রাস ও লাগামহীন চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, স্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র রক্ষা করতে হলে প্রত্যেকটি অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প পুনর্জীবিত করে সত্ত¡র সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণের ব্যবস্থা অনতিবিলম্বে সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হলে পাহাড়ে নতুন করে সন্ত্রাসের উম্মেষ ঘটার সম্ভাবনা প্রকট হবে। যা শান্তিপ্রিয় পাহাড়ী ও বাঙালীর জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন