সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গুম ও অপহরণের অভিযোগ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না

| প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশে গুম ও অপহরণের ঘটনা নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে চলছে। বিগত কয়েক বছরে এর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এ নিয়ে দেশের মানবাধিকার সংস্থা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুম ও অপহরণ করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি তুলে ধরা হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে বরাবরই এসব প্রতিবেদন অসত্য বলে অস্বীকার করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার এক প্রতিবেদনে আবারও বাংলাদেশে গুম ও অপহরণের পরিসংখ্যাণ তুলে ধরেছে। ‘তিনি আমাদের কাছে নেই: বাংলাদেশে গোপন আটক ও গুম’ শীর্ষক ৮২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবল ২০১৬ সালেই অন্তত ৯০ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখার কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ২১ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ৯ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই ৯০ জনের মধ্যে বিরোধী দলের তিন নেতার সন্তানও রয়েছেন। এ বছর প্রথম পাঁচ মাসে একইভাবে তুলে নেয়া হয়েছে ৪৮ জনের নিখোঁজ হয়েছে। প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য, প্রত্যক্ষদর্শীসহ মোট ১০০ জনের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ দিনে গুম হওয়া বিএনপির ১৯ নেতা-কর্মীর পরিবারেরও সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। প্রতিবেদনে এ তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২০১৩ সাল থেকে শত শত মানুষকে বেআইনিভাবে আটক করে গোপন স্থানে আটকে রেখেছে। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ গুম, খুন ও অপহরণের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশে আসাতে চেয়েছিল। সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এ প্রতিবেদনের সঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, মানবাধিকার সংগঠন অধিকার একমত পোষণ করেছে।
গুম, খুন ও অপহরণ বিষয়ে দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা নিয়মিতই প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। এসব প্রতিবেদন যে সর্বৈব অসত্য তা বলার সুযোগ নেই। যেসব পরিবারের সদস্য অপহরণের শিকার হয়েছে তাদের আহাজারি দেশের মানুষ টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় দেখেছে। পরিবারগুলো স্বজনকে ফিরে পাওয়ার জন্য মানববন্ধন থেকে শুরু করে হেন কোনো প্রচেষ্টা নেই যে অবলম্বন করেনি। সরকারের কাছে অকূল আবেদন জানিয়ে এ কথাও বলেছে, জীবিত না হোক অন্তত লাশটি যেন তারা ফিরে পায়। সরকারের তরফ থেকে বরাবরই গুম ও অপহরণের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। এবারের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পালিয়ে বেড়ালে গুম বলি কী করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কেউ নিখোঁজ হলে বা অপহৃত হলে এমনকি যদি পালিয়ে বেড়ানোর অভিযোগও উঠে, তাহলেও তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। আমরা দেখেছি, অপহৃত হওয়ার পর কেউ কেউ যখন ফিরে আসে, তখন তাকে কে বা কারা অপহরণ করেছে, এ নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তারা হতবিহŸল অবস্থায় থাকে। চেহারায় আতঙ্কের ছাপ থাকে। বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও কোনো বক্তব্য দেয়া হয় না। ঘটনাগুলো নীরবেই ঢাকা পড়ে যায়। অথচ অপহৃত ফিরে আসার পর কারা তাকে অপহরণ করেছে, তা শনাক্ত করে অপহরণকারীদের গ্রেফতার করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য অনেক সহজ হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। কোনো কোনো অপহরণ বা তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা রয়েছে, তা অপহৃতদের পরিবারের সদস্যরা অকপটে অভিযোগ করেছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অপহরণ ও গুমের অভিযোগ অহরহ করা হচ্ছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতই অস্বীকার করুক এসব প্রতিবেদন যে একেবারে ভিত্তিহীন, তা সচেতন মানুষ মনে করে না। সাধারণ মানুষের মধ্যেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য কর্তৃক তুলে নিয়ে গিয়েছে, এ ধারণা রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেছেন, ‘অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে। তারা যাকে যখন খুশি আটক করছে। তারাই সিদ্ধান্ত দিচ্ছে আটক ব্যক্তিদের শাস্তি কী হবে, তারা দোষী না নির্দোষ। এমনকি তুলে আনা ব্যক্তিদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে কি নেই, সেটাও তারাই ঠিক করছে।’ এ অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর এবং দেশ, জাতি ও সরকারের জন্য তা মোটেই সম্মানজনক নয়। বস্তুত, প্রতিবেদন অসত্য বলে উড়িয়ে দিলে অভিযোগের সুরাহা যেমন হবে না, দেশের মানুষও আশ্বস্ত হবে না।
অভিযোগ যেহেতু উঠেছে এবং প্রতিষ্ঠানটি যেসব তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছে, তা গুরুত্ব সহকারে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আমলেনেয়া প্রয়োজন। যেসব ব্যক্তি অপহৃত হয়েছে বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে, সেসব ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে জনসম্মুখে হাজির করার দায়িত্ব সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। যদি তা না করা হয় তবে, এ অভিযোগ সবার কাছেই সত্য বলে প্রতীয়মাণ হবে। কে কখন গুম, খুন ও অপহরণের শিকার হবে-এ আতঙ্ক মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াবে। বলা বাহুল্য, এরকম নিরাপত্তার শংকা বিদ্যমান থাকলে দেশ অগ্রসর হতে পারে না। এটা স্বীকার করতে হবে, দেশে গুম, খুন ও অপহরণ হচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে দেয়া যায় না। আমরা মনে করি, প্রতিটি অপহরণ, নিখোঁজ এবং এ সংক্রান্ত খুনের ঘটনার সাথে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের গ্রেফতার করে আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন