মুহাম্মদ আবদুল কাহহার : অর্থনৈতিক পরিভাষা রেমিট্যান্স, হুন্ডি শব্দগুলো প্রায়শই আমাদের নিত্যদিনের কথা-বার্তায় ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ রেমিট্যান্স অর্জন করায় সবমহলে আজ এটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে তুলে ধরা হয়েছে, গত অর্থবছরে প্রবাসিরা এক হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন। আগের বছরের তুলনায় ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছে সাড়ে ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম। বিগত বছরগুলোর প্রাপ্ত রেমিট্যান্স হিসাব থেকে জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক হাজার ৪৯৩ কোটি ১১ লাখ ডলার, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে এক হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এক হাজার ৪২২ কোটি ৮২ লাখ ডলার, ২০১২-১৩ অর্থবছরে এক হাজার ৪৪৬ কোটি ১১ লাখ ডলার, ২০১১-১২ অর্থবছরে এক হাজার ২৮৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলার, ২০১০-১১ অর্থবছরে এক হাজার ১৬৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এভাবে করে দু’একটি বছর ব্যতীত সবগুলো অর্থবছরেই রেমিট্যান্স ক্রমশ কমে আসছে।
আমরা জানি, পণ্য ও সেবা রপ্তানি এবং বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের স্বদেশে পাঠানো অর্থই রেমিট্যান্স। বাংলাদেশের মোট দেশজ (জিডিপি) আয়ের গড়ে প্রায় সাড়ে আট শতাংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। রেমিট্যান্সের প্রায় অর্ধেকের বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের সউদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইরান, ইরাক, কুয়েত, কাতার থেকে। রেমিট্যান্স কমতে থাকাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দুশ্চিন্তার বিষয় হিসেবে উল্লেখ করছেন। তবে যে সকল অবৈধ পথে বিদেশ থেকে টাকা আসছে, তা বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে এমন দাবী করলেও মাঠ পর্যায়ে তার বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ।
অবৈধপথে দেশে থেকে টাকা পাচার এবং একই পন্থায় দেশে টাকা আনার পদ্ধতির নাম হুন্ডি। এর মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্যস্থানে অর্থ প্রেরণের একটি ব্যক্তিগত পর্যায়ের কৌশল যা স্বল্পকালীন অপ্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক ঋণপত্র হিসেবে কাজ করে। হুন্ডি জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো সেবা দ্রæত পাওয়া যায়, কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই লেনদেন করা হয়, ডোর-টু-ডোর গিয়ে টাকা পৌঁছে দেয়া হয়, লেনদেনে কোনো বৈধ কাগজ-পত্রের প্রয়োজন হয় না। হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন খুব সহজে করা যায়। অতিরিক্ত কোনো ঝামেলা করতে হয় না। বাংলাদেশ আয় থেকে বঞ্চিত থাকে বলে হুন্ডি ব্যবসাকে অবৈধ ঘোষণা করলেও অনেক প্রবাসীরা তা মানছেন না। বৈধভাবে টাকা না আসলে বিদেশের টাকা বিদেশেই থেকে যায়। সাধারণ দৃষ্টিতে টাকা আসছে বলে মনে হলেও মূলত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর রেমিট্যান্স আহরণকারী ৩০ ব্যাংকের ব্যাংকরাদের বৈঠকে হুন্ডিকে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফের মতে, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার অন্যতম দু’টি কারণ হলো অনানুষ্ঠানিকভাবে টাকা পাঠানো বেড়েছে। এর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে। তেলের দাম কমে যাওয়ার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বেতন কমে গেছে। বিশ্বব্যাপী তেলের দাম কমে যাওয়ায় প্রবাসীদের উপার্জন কম হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর নানা সঙ্কটে ইউরো ও পাউন্ডের দাম পড়ে যাওয়ায় প্রবাসীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন বলে তারা দেশে টাকা কম কম পাঠাচ্ছেন। অপরদিকে প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে, যার ফলে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও কমেছে। আবার কেউ কেউ ব্যাংকের মাধ্যমে বৈধ উপায়ে অর্থ না পাঠিয়ে একটু বাড়তি লাভের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাচ্ছেন। প্রবাসী কর্মীরা হুন্ডিসহ নানা উপায়ে দেশে টাকা পাঠাতে আগের চেয়ে বেশি উৎসাহবোধ করার আরেকটি কারণ হলো ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কম। বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদরেকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় বলে তারা ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহারে আগ্রহ হারাচ্ছেন। আবার প্রবাসীদের বৃহৎ একটি অংশের বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তারা বিকল্প উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো রেমিট্যান্স ক্রমশ কমে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ৮টি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আয় করে থাকে। এর মধ্যে ৭টি দেশেই রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ বেড়েছে। রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ দুটি ধাপে হয়ে থাকে। প্রথমবার প্রবাসী ব্যাংকিং হাউসগুলোতে এবং দ্বিতীয়বার দেশীয় ব্যাংকে সার্ভিস চার্জ কর্তন করা হয়। রেমিট্যান্স পাঠাতে খরচ লাগবে না অর্থ মন্ত্রীর এমন বক্তব্য কতটা যুক্তিযুক্ত তা সময়ের ব্যাপার। এক কথায় বলতে গেলে পলিসিগত দুর্বলতার সুযোগে সারা দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রদানে হুন্ডি চালু রয়েছে।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি ১১টি ব্যাংকের রেমিট্যান্স আহরণে আগ্রহ নেই। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এক টাকাও রেমিট্যান্স আনেনি। অপর এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে প্রবাসীরা রাষ্ট্রায়ত্ব জনতা ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক ছাড়াও ব্র্যাক ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স কম পাঠিয়েছেন। অথচ একই বছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। অথচ সেই ব্যাংকটি সম্প্রতি কালো থাবার মুখোমুখি। তাই ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্স খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে হলেও রক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও দৈনিক পত্রিকাগুলোর বিভিন্ন সংবাদে বলা হয়েছে, রাষ্টায়াত্ত ব্যাংকসহ কতিপয় ব্যাংকের সেবার মান বাড়াতে হবে। কেননা, কোনো গ্রাহক একবার ব্যাংকে গিয়ে হয়রানি হলে সে দ্বিতীয়বার ব্যাংকিং ঝামেলায় যেতে চায় না। গ্রাহক যেখানে সহজ উপায়ে যত দ্রæত সেবা পাবে সেখান থেকেই সে অর্থনৈতিক লেনদেন করে। ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা যদি কাঙ্খিত মানের হতে পারে তাহলে সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান নি¤œ হবে কেন, সেটি অনেকেরই প্রশ্ন। সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ শাখার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ দেশের সর্বত্রই লক্ষণীয়। সে কারণে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। সপ্তাহের সবকটি দিনই সাধারণ মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধাগুলো পাচ্ছে বলে সে দিকেই বেশি ঝুকছেন। এটা কমাতে হলে দেশীয় গ্রাহক ও প্রবাসীদের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আন্তরিক হতে হবে।
প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অদক্ষ। তাই আগামীদিনগুলোতে যারা প্রবাসে যেকে ইচ্ছুক তাদেরকে প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকে পাঠানো ঠিক হবে না। ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটির অধিক মানুষ বিদেশে গেছেন। গবেষণা থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত যারা বিদেশে গেছেন তাদের ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশই অদক্ষ। দক্ষ জনশক্তি রফতানি খাতকে আরও অগ্রসর হতে হবে।
সর্বোপরি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে ব্যাপকভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একই সাথে রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রেমিট্যান্স ক্রমশ কমতে থাকলে রিজার্ভ কমে যাবে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনৈতিক ভারসাম্য হারাবে। রেমিট্যান্স কমে যাওয়া দেশের জন্য অশনিসংকেত। তাই প্রবাসীরা মাতৃভূমির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অংশ হিসেবে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার প্রতি আন্তরিক হবেন বলে আশা পোষণ করছি।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন