আক্রান্তদের চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালে হেল্পডেক্স চালু
হাসান সোহেল : রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া মহামারী আকার ধারণ করেছে। নগরীর লাখ-লাখ লোক চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এখনও প্রতিদিন নতুন করে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের অনেক ছুটছেন হাসপাতালে। আবার কেউ বাড়িতে অবস্থান করেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকুনগুনিয়া প্রথমদিকে রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়লেও এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীর বাইরের জেলা-উপজেলাতে। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার লোকও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম এখন সবখানেই মিলছে চিকুনগুনিয়ার রোগী। চিকুনগুনিয়া নিয়ে সর্বত্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। যদিও গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক চিকুনগুনিয়ার প্রকোপকে ‘মহামারী’ উল্লেখ করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তার মতে, এটা আগের চেয়ে কমে আসছে। একই সঙ্গে উন্নতির দিকে। রোগের প্রকোপ কমাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণারয় ব্যর্থ কিনা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ চিকিৎসা দেয়া। তা করা হচ্ছে। মশা মারার দায়িত্ব আমাদের না। এটা সিটি কর্পোরেশনের। সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়রের সাথে এতোমধ্যে একাধিকবার বৈঠক করা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকেই রাজধানীতে মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। যা পরবর্তীতে মহামারী আকার ধারণ করে। কিন্তু রোগ শুরু থেকে এই পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ার বিস্তার ঠেকাতে কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সিটি করপোরেশন। চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নিতে না পরায় এই রোগ এখন রাজধানীর পর জেলা-উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
চিকুনগুনিয়ায় পর্যবেক্ষণ করতে রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু করেছে গত ৩ জুলাই থেকে। আইইডিসিআরের নিয়ন্ত্রণের কক্ষের গত ৯ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৮ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ল্যাবরেটরীতে চিকুনগুনিয়া রোগীর সংখ্যা ৫৫৬ জন। ওইদিন ১৬৫ জন লোক হটলাইনে এবং ১৮ জন সরাসরি হাজির হয়ে চিকুনগুনিয়া সম্পর্কে তথ্য জানেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ ঢাকার এবং কয়েকজন মাদারীপুরের বাসিন্দা ছিলেন। অর্থাৎ চিকুনগুনিয়ার বিষয়ে রাজধানীর বাইরের জেলা থেকেও চিকুনগুনিয়ার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে মাদারীপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, লালমনিরহাট চিকুনগুনিয়ার রোগীর পাওয়া গেছে। এজন্য প্রতিটি জেলায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলার জন্য সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ৩ জুলাই প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় প্রতি ১১ জনের মধ্যে ১ জন (অর্থাৎ ৯ শতাংশ) লোক চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। মুঠোফোনের মাধ্যমে পরিচালিত এক জরিপ থেকে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব অনুযায়ী, ৯ শতাংশ লোক চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে রাজধানীতে চিকুনগুনিয়ার রোগী প্রায় ১৮ লাখ। কারণ রাজধানীতে প্রায় ২ কোটি লোক বসবাস করে। আইইডিসিআরের তথ্যমতে, চিকুনগুনিয়া ভাইরাস টোগা ভাইরাস গোত্রের ভাইরাস। এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস এলবোপিকটাস মশার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। এ ধরণের মশা সাধারণত দিনেরবেলায় (ভোরবেলা অথবা সন্ধ্যার সময়) কামড়ায়। এই মশাগুলো সাধারণত পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে জন্মায় এবং যাদের আশেপাশে এ ধরনের মশা জম্মানোর জায়গা আছে, সেখানকার মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
চিকুগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ হচ্ছে- হঠাৎ জ্বর আসা, সঙ্গে প্রচন্ড গিটে গিটে ব্যথা, প্রচন্ড মাথাব্যথা, মাংসপেশীতে ব্যথা শরীরে ঠান্ডা অনুভ‚তি, বমি বমি ভাব অথবা বমি, চামড়ায় লালচে দানা। চিকুনগুুনিয়া এমনি এমনিই সেরে গেলেও কখনো কখনো গিটের ব্যথা কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছরের বেশি সময় থাকতে পারে। এই জ্বর ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত হতে পারে। চিকনগুনিয়া ভাইরাস জ্বর ভালো হলেও ব্যথা থাকে দীর্ঘ সময়। এ রোগ প্রতিরোধে কোনো ভ্যাকসিন নেই।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. মোজাহেরুল হক, চিকুনগুনিয়া একটি মশাবাহিত রোগ। এটি আফ্রিকায় প্রথম ধরা পড়ে। এটি এখন ঢাকায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। পর্যায়ক্রমে চিকুনগুনিয়া গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন, চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধে কাজ করার কথা স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। স্থানীয় সরকারের আওতাধীন সিটি করপোরেশন যদি মশা নিধন কর্মস‚চি সঠিকভাবে পালন করা হতো; তাহলে মশার বংশ বিস্তার ঘটতে না। মশক নিধনের পাশাপাশি জনসেচতনতা বাড়ানো সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। দেখা গেলো সিটি করপোরেশন রাস্তা ও বাড়ির আশপাশের মশা মারলো এবং আবর্জনা পরিস্কার করলো; কিন্তু জনসচেতনতা সৃষ্টি না করায় বাসার ভেতরে যে মশা রয়েছে সেগুলো মারলো না। বাসার ভেতরের মশা মারার কাজ করতে হবে বাসায় যারা থাকেন তাদের। এটা জানানোর জন্য সৃষ্টি করপোরেশনকে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করতে হবে। পাশপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও জনসচেতনতার সঙ্গে আক্রান্তদের জন্য করণীয় নির্ধারণ এবং সব ধরনের প্রস্তুতি রাখা।
এদিকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যেসব রোগীর সন্ধান মিলেছে; তারা ঢাকায় এসে মশা দ্বারা আক্রান্ত বলে দাবি করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চিকুনগুুনিয়া লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই বলেও জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল (সোমবার) বিকালে কমিটি প্রথম বৈঠক করেছে। কমিটি চিকুনগুনিয়ার পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে হাতে গোনা ২/৩ জন রোগীর খবর পাওয়া গেছে তারা সাধারণত থাকাকালীন সময়ে মশার কামড় খেয়েছেন। পরবর্তীতে গ্রামের বাড়ি গিয়ে চিকুনগুনিয়া দেখা দিয়েছে। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যেসব রোগী ঢাকায় এসে পরীক্ষা করিয়েছেন তাদের চিকুনগুনিয়া নেগেটিভ (হয়নি) পাওয়া গেছে।
তিনি আরও বলেন, চিকুনগুুনিয়া জ্বর যে পরিবেশে ছড়ায় তার জন্য ঢাকা উপযুক্ত। বৃষ্টি হলে ঢাকার পানি সহজে সরে না। মশার প্রজনন ক্ষেত্রের জন্য পানি খুবই জরুরি। কিন্তু জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বৃষ্টি হলে সেখানকার পানি আটকে থাকে না। সরে যায়। এ কারণে চিকুনগুনিয়া যে মশার দ্বারা ছড়ায় সেই মশা বংশ বিস্তার করতে পারে না। ফলে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রন) প্রফেসর ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, এ বছর আগাম বর্ষার কারনে এ রোগের প্রকোপ বেড়েছে। বৃষ্টি একটু কমলে রোগের প্রকোপও কমবে। যেহেতু ইতিপূর্বে এ রোগ আমাদের দেশে তেমন প্রভাব বিস্তার করেনি তাই এবছর এর বিস্তৃতি বেশি বলে মনে হচ্ছে। অধিদফতরের বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মকান্ডে ইতিমধ্যে রোগের প্রকোপ কিছুটা কমেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। সরকারের আইইডিসিআর’র বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বৃষ্টির গতি প্রকৃতি অনুযায়ী আগামী সেপ্টেম্বরের আগে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ থামছে না।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি মোকাবেলায় হেল্প ডেস্ক খোলা হচ্ছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণারয় সূত্রে জানা গেছে। পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধির ব্যথা প্রশমনে প্রতিটি হাসপাতালে প্রয়োজনে জয়েন্ট পেইন ক্লিনিক বা আর্থালজিয়া ক্লিনিক খোলারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখান থেকে রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি বা ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হবে। দেশের সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ জেলা ও উপজেলা হাসপাতালেও এই সেবা দেওয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন