রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জনসম্পদ ও কর্মসংস্থানের বাস্তবতা

| প্রকাশের সময় : ১২ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এফডিআই বা বৈদেশিক বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকা সত্বেও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রয়েছে একদিকে বৈদেশিক কর্মসংস্থান অন্যদিকে সুলভ জনশক্তির উপর গড়ে ওঠা শ্রমঘন রফতানীমুখী তৈরী পোশাক শিল্পের উপর ভিত্তি করে। আর বৈদেশিক মূদ্রা আয় করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা পালনকারি এই দু’টি খাতই গড়ে উঠেছে দেশের বিপুল কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে ভিত্তি করে। স্বাধীনতাত্তোর দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত বাংলাদেশে জনসংখ্যাকে বোঝা অথবা অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অধিক জনসংখ্যাকে দেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে দেশি-বিদেশি নানা উদ্যোগ, প্রচারনাও ছিল চোখে পড়ার মত। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে যথাক্রমে চীন ও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব যথাক্রমে আটগুন ও চারগুন বেশী। তবে জনসংখ্যা নিয়ে আগে যে উদ্বেগ ছিল স্বাধীনতার সাড়ে চারদশক পেরিয়ে সে অবস্থা অনেকটাই পাল্টে গেছে। জনসংখ্যাও সাড়ে সাত কোটি থেকে ১৬ কোটিতে দাড়িয়েছে। সর্বশেষ শুমারি অনুসারে বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ২৭ লক্ষ। এদের মধ্যে ১০ কোটি ৬০ লাখই কর্মক্ষম নারী-পুরুষ। এক সময় দেশে নারীদের কর্মসংস্থান খুব সীমিত থাকলেও গার্মেন্টস শিল্পের প্রসারের মধ্য দিয়ে অশিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত গ্রামীণ যুবাদেরও বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অবস্থার অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। তবে এ ক্ষেত্রে আরো বেশী সম্ভাবনা থাকা সত্বেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও সময়োপযোগি পরিকল্পনা না থাকায় তা কাজে লাগানো যায়নি।
গতকাল ছিল বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এ উপলক্ষ্যে পত্রিকাগুলোতে আমাদের জনসংখ্যা ও ডেমোগ্রাফির যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা’ খুব বেশী সুখকর নয়। বিশেষত: বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তির জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার চিত্রই প্রকাশিত হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিবছরই বাড়ছে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, বর্তমান সরকারের প্রথম চারবছরে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ কর্মসংস্থান হলেও এরপর থেকে ২০১৬ অর্থবছর পর্যন্ত মাত্র ১৪ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে। কর্মসংস্থান প্রত্যাশি মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে যেখানে দেশি-বিদেশি কর্মসংস্থানের হ্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল, সেখানে তা’ গত কয়েক বছরে অর্ধেকে নেমে আসার বাস্তবতা উদ্বেগজনক। ক্রমবর্ধমান বেকার জনসংখ্যার টানপোড়েন থেকে হতাশা, মাদকাসক্তিসহ নানা ধরনের সামাজিক অপরাধ-অবক্ষয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। জনসংখ্যাবৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে আগামী দশকশেষে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটিতে উন্নীত হতে পারে বলে প্রিডিকশন করা হচ্ছে। এমনিতেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে দেশের কৃষিজমির উপর চাপ বাড়ছে, শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে। বনভ’মি উজাড়সহ অনিয়ন্ত্রিত কৃষি ও শিল্পদূষণের ফলে পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। বিগত দশকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের বেধে দেয়া (এমডিজি বা মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল) সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেশ সাফল্য অর্জনে সক্ষম হলেও পরবর্তিতে নির্ধারিত এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন খুবই হতাশাজনক। যেনতেন প্রকারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে পরিবেশগত সুরক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপসহ জনশক্তিকে কার্যকর জনসম্পদে রূপান্তরিত করে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করাই সরকারের মূল দায়িত্ব।
দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬৫ ভাগেরই বয়েস ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। এই জনশক্তিকে কর্মক্ষম জনশক্তি হিসেবে ধরা হয়। যদিও আমাদের দেশে নানা কারণে লাখ লাখ শিশু শ্রমিক এবং বয়োবৃদ্ধ মানুষও সেবা ও উৎপাদনশীল কর্মে নিয়োজিত আছে। ষাটের দশকেও চীন, কোরিয়া , মালয়েশিয়ার মত দেশের অর্থনীতির সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির এমন পার্থক্য ছিলনা। যে সব পরিকল্পনা ও উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মধ্য দিয়ে এসব দেশ আজকের অবস্থানে উপনীত হয়েছে, আমরা সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহন করিনি। মালয়েশিয়া, জাপান বা কোরিয়ায় সোনার খনি বা তেলের খনি নেই, দেশের সীমিত সম্পদ, উদ্ভাবনী প্রতিভা, মেধা ও জনশক্তিকে কাজে লাগিয়েই তারা এশিয়ায় উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে উঠেছে। আর আমাদের যুবকরা দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়াড় জঙ্গল ও উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা বা জাপান-মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে। আমরা যখন ২০৪১ সালের মধ্যে জাতিকে একটি উন্নত অর্থনীতির বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখাচ্ছি, তখনো সেই পরিকল্পনা বা স্বপ্ন বাস্তবায়নের কোন বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ দেখছিনা। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুনগত মানোন্নয়নের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দেশকে বাসযোগ্য রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের বিরুদ্ধে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করার ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য প্রথমেই দেশে একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সমঝোতা ও সহাবস্থানমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন