স্টাফ রিপোর্টার : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণের বড় বড় চালানের পাশাপাশি আসছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। গত তিন বছরে ৩২৭টি অস্ত্র শতাধিক ড্রোন ও প্রচুর বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করেছে শুল্ক ও গোয়েন্দা ও বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা।
ফলে বিমানবন্দরের নিরাপত্তাও এখন হুমকির মুখে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বিভাগের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, খেলনা ঘোষণা দিয়ে দেশের আকাশ পথে ঢুকছে ড্রোন, রোবট ও অত্যাধুনিক অস্ত্র। দীর্ঘদিন ধরেই একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গোপনে আকাশপথে প্রাণঘাতি এসব অত্যাধুনিক সরঞ্জাম নিয়ে আসছে। স্বর্ণের বড় বড় চালা আসার পর সম্প্রতি অস্ত্র আমদানি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। গত মঙ্গলবার বিমানবন্দরের ফ্রেইট ইউনিটে ১৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ধরা পড়ে। এ ঘটনার নেপথ্যের অপরাধীরা রয়েছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এগুলো মেসার্স ইমরান আর্মস অ্যান্ড কোম্পানির নামে আমদানি করা হয় বলে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান।
আটক করা এসব অস্ত্রের মধ্যে ওয়ালথার পিপি ১৪টি ও ৫টি এইচকেফোর ব্র্যান্ডের পিস্তল। এ ঘটনায় গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার বা আটক করতে পারেনি পুলিশ বা শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগ। শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, এক চালানে ইতালি থেকে মোট ৫৮টি অস্ত্র আনে ইমরান আর্মস অ্যান্ড কোম্পানি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এর আগে গত রোববার বিমানবন্দরের এয়ারকার্গো থেকে আমদানি নিষিদ্ধ দুটি ওয়ালথার পিপি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। আমদানি নীতি অনুযায়ী পুরানো ও অকার্যকর অস্ত্র আনার উপরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইমরান আর্মস অ্যান্ড কোম্পানির বিক্রয় কেন্দ্র ঢাকার বায়তুল মোকাররমে। গত রোববার ২টি অস্ত্র আটকের পর সোমবার এই প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধান চালান শুল্ক গোয়েন্দারা। এই শোরুমে ১৬১টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র পাওয়া গেলেও তার সপক্ষে কোনো কাগজ তাৎক্ষণিকভাবে দেখাতে পারেনি। তাছাড়া ভ্যাট ব্যবস্থাপনায়ও গড়মিল রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানান। বিমানবন্দর থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ কে এম নুরুল হুদা আজাদকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত তদন্ত কমিটি এ ব্যপারে উল্লেখযোগ্য কোন তথ্যই দিতে পারেনি।
একটি গোয়েন্দ সূত্র জানায়, বিমানবন্দরে কর্মরত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট অস্ত্র, ড্রোন, বোমা তৈরীর সরঞ্জাম এবং স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। এ সিন্ডিকেটের সাথে কাস্টমস, বিমান, সিভিল এভিয়েশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত। বিভিন্ন সময় চোরাচালান ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত থাকার অপরাধে এদের কয়েকজনকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। এ বরখাস্ততেই সীমবদ্ধ। স্বর্ণ চোরাচালান, আদম পাচার এবং অস্ত্র আমদানিকারক অসাধু চক্রকে সহযোগিতা করে আসছে এমন ১৭০ জনকে শনাক্ত করেছে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে অধিকাংশই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কর্মরত। দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠরা কাস্টমস বিভাগে কর্মরত। এদের দ্রæত গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছে ওই সংস্থার একজন কর্মকর্তা। ইতোমধ্যে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার কারণে বিমানের ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
বিমানবন্দর ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত তিন বছরে হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই ৩২৭টি অস্ত্র এবং শতাধিক ড্রোন উদ্ধার হয়েছে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা নাশকতার জন্য মিথ্যা ঘোষণায় ওসব সরঞ্জাম দেশে আনা হচ্ছিল। আবার কিছু সন্ত্রাসী গ্রæপ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেও অবৈধ অস্ত্র আমদানি করছে। আর এখন পর্যন্ত দেশে কী পরিমাণ ড্রোন-রোবটের মতো সরঞ্জাম ঢুকেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা তা নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে তারা বিমানবন্দরে ড্রোন, রোবট ও অস্ত্রের চালান আটকের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ ড্রোন তৈরির সরঞ্জামসহ ইতিপূর্বে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুই সদস্যের কাছ থেকে জঙ্গিদের ড্রোন ব্যবহারের পরিকল্পনা সম্পর্কে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মইনুল খান জানান, আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী ড্রোন, রোবট আমদানি নিষিদ্ধ। ড্রোনে বোমা সংযোজন করে যে কোনো নাশকতা করা যেতে পারে। এমনকি তাতে ক্যামেরা বসিয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো স্থাপনার ছবি ও তথ্যও সংগ্রহ করা যায়। নিরাপত্তার জন্য ড্রোনের অপব্যবহার ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে ওই ড্রোন আমদানি ও ব্যবহার সম্পর্কে নীতিমালা তৈরি প্রক্রিয়াধীন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রিমোট কন্ট্রোল চালিত ড্রোন নিঃশব্দে ৪৫ কি.মি. বেগে ছুটে চলতে পারে। ওসব ড্রোনের মাধ্যমে ক্যামেরা বসিয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো স্থাপনার ছবি ও তথ্য সংগ্রহ যেমন করা যায়, আবার বোমা সংযোজন করে ওসব স্থানে বিস্ফোরণ ও হামলা করাও সম্ভব। আটক হওয়া খেলনা বলে দেশে আসা ড্রোন, রোবট ও অস্ত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেছে ওগুলো আদৌ খেলনা নয়। প্রাণঘাতি অস্ত্র হিসাবেই ওসব সরঞ্জামাদি ব্যবহার হয়ে থাকে। এই পরিস্থিতিতে দেশের যে কোনো স্পর্শকাতর স্থানেই জঙ্গিরা ড্রোনের মাধ্যমে প্রাণঘাতি হামলা চালানোর আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারছে না পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
সূত্র জানায়, স¤প্রতি হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৫৮টি বিদেশী পিস্তল উদ্ধার করেছে। এছাড়া গতবছর ৯টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত দুই জার্মান নাগরিককে আটক করা হয়। আটককৃতরা ওসব অস্ত্রকে খেলনা হিসাবে দাবি করলেও প্রাথমিক পরীক্ষার পর গোয়েন্দা নিশ্চিত হয়েছেন এগুলো খেলনা নয়, বিভিন্নভাবে এগুলো ব্যবহার করা যাবে। পিস্তলের ব্যারেল পরিবর্তন করলেই ওগুলো আসল পিস্তলে রূপ নেবে। ওই অস্ত্র দিয়ে বুলেট ব্যবহার করে প্রাণহানি সম্ভব। তাছাড়া গ্যাসও ব্যবহার করা যাবে। এর কয়েকদিন আগেই শাহজালাল বিমানবন্দরে ১৫ কেজি ওজনের একটি রোবট ও বিপুল পরিমাণ গোয়েন্দা সামগ্রী আটক করা হয়। ওসব মালামাল খেলনা ঘোষণা দিয়ে আনা হয়েছিল।
সূত্র আরো জানায়, একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ওসব প্রাণঘাতি সরঞ্জামাদি দেশে আনছে। যেসব খেলনা দেশে আনা নিষিদ্ধ সিন্ডিকেটটি ওসবই আমদানি করছে। ইতিমধ্যে ওই সিন্ডিকেটের হোতাদের চিহ্নিত করেছে বিমান বন্দরের একটি সংস্থা। ওই সিন্ডিকেট ড্রোন এবং রোবট আনছে। আর খেলনা অস্ত্রসহ আটক দুই ব্যক্তি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজধানীর একজন অস্ত্র ব্যবসায়ীর জন্য এনেছিল বলে জানিয়েছে। এ অবস্থায় দেশের নিরাপত্তা স্বার্থে বিমানবন্দরে গোয়েন্দা তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। কারণ ড্রোন-রোবট ও অস্ত্র নানা ধরনের নাশকতার কাজে ব্যবহার হওয়ার আশঙ্কায় সম্প্রতি বাংলাদেশে ওসব আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ফলে সরকারের অনুমতি ছাড়া ড্রোন আমদানি করা যায় না।
এদিকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত এক বছরে ২৭০টিরও বেশি চালকবিহীন ছোট উড়ন্ত যান বা ড্রোন আটক করা হয়। এক একটি ড্রোন প্রতি ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে। তার সাথে উন্নতমানের ক্যামেরা আর সেন্সর রয়েছে। গত বছর ২৬ জুলাই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পোস্টাল পার্সেলে আনা বোমা বহনে সক্ষম ড্রোন আটক করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর থেকে আসা চার কেজি ওজনের দুটো প্যাকেটের পার্সেল থেকে ওই ড্রোনটি আটক করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন