শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বেপরোয়া ছাত্রলীগ

| প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রাজধানীসহ সারাদেশে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নানা অপকর্ম ও ত্রাস সৃষ্টির বিষয়টি নতুন নয়। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দল, সংঘাত, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, খুন, মারামারির ঘটনা নিয়মিত হয়ে পড়েছে। গত বৃহস্পতিবার সিলেটের সিএমসি কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের বিরোধের জের ধরে ছাত্রাবাসের ৩৯টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। ছাত্রলীগের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন। যারা অপরাধে সংশ্লিষ্ট তাদের কাউকে কাউকে সাময়িক বহিষ্কার করার ঘটনাও আছে। তবে সময় গড়িয়ে যাওয়ার পর দেখা যায়, অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে রয়েছে। এবার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। দুজনের বিলাসী জীবন, টাকার ভাগাভাগি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ এবং কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও থেকে যাওয়া নিয়ে। অভিযোগ উত্থাপন করেছেন সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এ নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। সারাদেশে ছাত্রলীগের অনিয়ন্ত্রিত অপকর্ম নিয়ে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হলেও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কোনো ভ্রুক্ষেপ করছে না। বরং দিন দিন তাদের অপকর্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার যেন কেউ নেই।
ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের সুনাম থাকলেও, বিগত কয়েক বছর ধরে এর অপকর্ম সবকিছু ম্লান করে দিচ্ছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধর, শিক্ষক লাঞ্ছনা, আভ্যন্তরীণ সংঘাত, খুনসহ ৩৭টি ঘটনায় ছাত্রলীগ গণমাধ্যমের সংবাদ হয়েছে। যার মধ্যে ১২টি ঘটনার সঙ্গে আধিপত্য বিস্তার ও আর্থিক বিষয় জড়িত। এছাড়া নারী সংক্রান্ত কেলেংকারি তো রয়েছেই। এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ডে সংগঠনটির ভাবমর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণে বিরক্ত হয়ে এক সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এর অভিভাবকত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী বহুবার ছাত্রলীগকে হুশিয়ার করে বক্তব্য দিয়েছেন। সর্বশেষ ১১ জুন ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় তিনি বলেছেন, টাকার জন্য কোনো অপকর্মে যাওয়া যাবে না। টাকার দরকার হলে আমার কাছে আসবে। আমি নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব। এসব হুশিয়ারি ও আহ্বান সত্তে¡ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সাড়া মেলেনি। তারা একের পর এক তান্ডবীয় কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধেই যখন বিলাসী জীবনযাপন ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ উঠে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না পুরো সংগঠনটি কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এটা অচিন্তনীয় বিষয় যে, ছাত্রাবস্থায় ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে অন্যান্য নেতা-কর্মীরা ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রাবস্থায়ই কোটিপতি বনে যাওয়ার এমন ছাত্ররাজনীতি বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা, আমাদের জানা নেই। অথচ ছাত্র সংগঠনের কাজ হচ্ছে শিক্ষাঙ্গণে পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করা। আদর্শিক জীবনযাপনে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করা। আমাদের দেশের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ চিত্রই ফুটে উঠে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার ইতিহাস সবার জানা। রাষ্ট্রের যে কোনো দুঃসময়ে ছাত্র সংগঠন ভ্যানগার্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংগঠনগুলো কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন না হলেও আদর্শগত কারণে তারা রাজনৈতিক দলের সমর্থক এবং পাশে দাঁড়ায়। দুঃখের বিষয়, আমাদের ছাত্র রাজনীতি এখন আর সেই আদর্শগত জায়গায় নেই। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের আদর্শ ধারণকারী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ বিগত বছরগুলোতে যে অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটিয়েছে এবং ঘটিয়ে চলেছে, তা এই সংগঠনের আদর্শের ধারেকাছেও নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা শিক্ষাঙ্গণে ত্রাস ও দখলদারিত্ব কায়েম করেছে। হল দখল থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, মাদক ব্যবসা, নারী কেলেংকারি, ছিনতাইয়ের মতো অমার্জনীয় অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। বিরোধী আদর্শের ছাত্র সংগঠনকে ক্যাম্পাস ছাড়া করে সুষ্ঠু ও আদর্শগত প্রতিযোগিতামূলক ছাত্র রাজনীতি বিতাড়িত করেছে। ক্ষমতার দাপটে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আইন-কানুনের কোনোরূপ তোয়াক্কা করছে না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেকটা জিম্মি হয়ে রয়েছে। তার আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সৃষ্ট সন্ত্রাসী কার্যকলাপে শিক্ষাঙ্গণ বন্ধ হয়ে পড়ছে। শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে। ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীর কাছে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছাত্রলীগের অপকর্ম নিয়ে বহুবার লেখালেখি হয়েছে। এতে সংগঠনটি ও সরকারের টনক নড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের মনে হতে পারে, ছাত্রলীগের অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকুক, এটাই সরকার চাচ্ছে। তা নাহলে অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেন? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও যখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী কর্তৃক মারধরের শিকার হয়, তখন তারাও কেন নিশ্চুপ থাকছে? সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে বরাবরই তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা গেছে। এখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। অর্থাৎ গোড়ায় গলদ দেখা দিয়েছে। যে সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দই অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন, সে সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা মনে করি, ছাত্রলীগের এহেন অপকর্ম সরকারের পক্ষ থেকে বরদাস্ত করা উচিত হবে না। সংগঠনটির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ জরুরি। তা নাহলে এর দায় সরকারি দলের উপরই বর্তাবে। এ দায় থেকে মুক্ত হতে হলে ছাত্রলীগের যেসব নেতা-কর্মী অপকর্মে জড়িত এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে ছাত্রলীগকে কলুষমুক্ত করা অপরিহার্য।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন