রফিকুল ইসলাম সেলিম : প্রায় একযুগের বেশি সময় পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি পেয়ে উজ্জীবিত চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসাবে চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপিতেও নতুন কমিটি দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর শেষে দুই জেলায় নতুন কমিটি অনুমোদন দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট নেতারা জানিয়েছেন।
এদিকে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপিতে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে ২৭৫ সদস্যের কমিটিতে সবাইকে খুশি করার চেষ্টা সফলও হয়েছে বলে মনে করছেন দলের নেতারা। কারণ কমিটি ঘোষণার পর এ নিয়ে এখনও প্রকাশ্যে কোন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। অতীতে কমিটি গঠনের পর থেকে দীর্ঘদিন টানা অসন্তোষ চলতে দেখা গেছে। এবার তেমনটা হয়নি। তবে এবারের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে কিছু নেতা পদ-পদবী বন্টনে জ্যেষ্ঠতা লঙ্গনের অভিযোগ করেছেন। বলা হচ্ছে সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে জুনিয়রদের বড় পদ দেওয়া হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি চূড়ান্ত করার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তারা বলছেন, এমন অভিযোগ পুরোপুরি সঠিক নয়। যোগ্যদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। যারা বেশি সময় দিতে পারবেন তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। সিনিয়রদের ও ভাল পদে বসানো হয়েছে।
বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নতুন কমিটি নিয়ে তারা খুশি। দীর্ঘদিন কমিটি না থাকায় নেতারা ছিলেন পদবঞ্চিত। এখন পদ পেয়ে নেতারা যেমন খুশি, তেমন খুশি তাদের সমর্থকরা। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, মহানগর সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর তরুন। নতুন কমিটিতে তরুনদের এগিয়ে আনা হলেও প্রবীণদের সরিয়ে দেওয়া হয়নি। তাদেরকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে নানা পেশার প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে। এটাও একটা ভাল দিক।
দলের কয়েকজন নেতা জানান, চট্টগ্রাম নগর বিএনপিতে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ-বিভক্তি আছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুসারীদের ঘিরেই এ বিরোধ ঘুরপাক খায়। এবারের কমিটিতে এসব নেতাদের যারা অনুসারী তাদের প্রায় সকলে স্থান দেওয়া হয়েছে। এরফলে আপাতত বিরোধ তেমন প্রকট হবে না-এমন ধারণা করছেন দলের নেতারা। সোমবার দলের চেয়ারপার্সনের নির্দেশক্রমে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৭৫ সদস্য বিশিষ্ট চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির এই পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেন।
মহানগর কমিটি গঠনের পর শুরু হয়েছে থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া। বুধবার মহানগরীর ৭টি থানা ও ৮টি ওয়ার্ডে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, পর্যায়ক্রমে নগরীর ১৬টি থানা ও ৪১টি ওয়ার্ড নতুন কমিটি গঠন করা হবে। ইতোমধ্যে কিছু ওয়ার্ডে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি হয়েছে। তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব তুলে আনতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিএনপিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
অপরদিকে চট্টগ্রাম মহানগরের মতো উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির নতুন কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এই লক্ষ্যে কাজ করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম বিএনপির কমিটি গঠনের জন্য দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানসহ কয়েকজন নেতাকে দায়িত্ব দেন। দলের একজন কেন্দ্রিয় নেতা জানান, চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজ চলছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে কমিটির প্রাথমিক তালিকা তৈরী করা হবে। চেয়ারপার্সন লন্ডন সফর থেকে ফিরলে কমিটি চূড়ান্ত করা হবে।
চলতি বছরের মে মাসের শুরুতে কেন্দ্রিয় নেতাদের উপস্থিতিতে সংঘাতের জেরে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গাজী মোহাম্মদ শাহজাহান জুয়েল ও উত্তর জেলার সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল হাসান চৌধুরীকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। দুই জেলার গুরুত্বপূর্ণ পদের দুই নেতাকে বহিস্কারের পর ওই পদে আসতে একাধিক নেতা জোর চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীও নিজের পদ ধরে রাখার চেষ্টায় আছেন। জাতীয় কাউন্সিলের পর ঘোষিত কেন্দ্রিয় কমিটিতে বড় কোন পদ পাননি তিনি। আর তাই জেলা সভাপতি পদে তার বহাল থাকার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করেন দলের নেতারা। উত্তর জেলা বিএনপির আহবায়ক আসলাম চৌধুরীকে কেন্দ্রিয় যুগ্ম মহাসচিব করা হয়েছে। দলীয় গঠনতন্ত্রে নতুন করে সংযুক্ত ‘এক নেতার একপদ’ নীতি কার্যকর হলে উত্তর জেলায়ও সভাপতি পদে নতুন কেউ আসতে পারেন। এমন সম্ভাবনা সামনে রেখে দলের একাধিক নেতা সভাপতি পদে আসতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ওই দুই জেলার নতুন কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট একজন কেন্দ্রিয় নেতা জানান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপিতে বিরোধ তেমন নেই। পটিয়া কেন্দ্রিক বিরোধের জেরে গাজী জুয়েল বহিস্কৃত হয়েছেন। জেলা নেতাদের মধ্যে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আসার মতো একাধিক যোগ্য নেতা রয়েছেন। যারা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য তাদের নেতৃত্বেই দক্ষিণ জেলার কমিটি হবে। উত্তর জেলা বিএনপিতে বিরোধ প্রকট। এই বিরোধের জেরে জেলার সদস্য সচিব দল থেকে বাদ পড়েছেন। এক নেতার একপদ কার্যকর হলে আহবায়ক আসলাম চৌধুরীও বাদ পড়তে পারেন। উত্তর জেলায়ও অনেক নেতা আছেন, যারা কোন গ্রæপিং কোন্দলে নেই তাদের সমন্বয়ে নতুন কমিটি করা হবে।
উত্তর জেলা বিএনপিতে কোন্দল দীর্ঘদিনের। দলের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সভাপতি আর আসলাম চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করার পর বিরোধ আরও চরমে উঠে। পরে ওই কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে আসলাম চৌধুরীকে আহবায়ক ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী হিসাবে পরিচিত রাউজান পৌরসভার সাবেক মেয়র হাসান চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে আহবায়ক কমিটি করা হয়। কমিটিকে একবছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে বলা হয়। বিরোধের জেরে জেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। উপজেলা ও পৌরসভাতে হয় পাল্টা-পাল্টি কমিটি।
দক্ষিণ জেলা বিএনপির নতুন কমিটি গঠন নিয়ে চট্টগ্রামের কেন্দ্রিয় নেতাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। একসময় দক্ষিণ জেলার কমিটি কাদের নিয়ে হবে ঠিক করে দিতেন দলের স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য কর্ণেল (অব.) অলি আহমদ। এখন তিনি অন্যদলে। তবে চট্টগ্রাম উত্তর জেলার কমিটি নিয়ে কেন্দ্রের বেশ কয়েকজন নেতা সক্রিয়। তাদের সকলের বাড়ি উত্তর জেলায়। তারা হলেন দলের ভাইস চেয়াম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা উত্তর জেলার সাবেক সভাপতি গোলাম আকবর খোন্দকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন