জামালউদ্দিন বারী : দেশের অন্তত বিশটি জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ, ফসলের মাঠ প্রলম্বিত বন্যার করাল গ্রাসে নিমজ্জিত। গত মাসের মাঝামাঝি থেকেই বন্যা পরিস্থিতির অবনতি শুরু হয়েছিল। প্রায় একমাস অতিক্রান্ত হলেও এখনো অধিকাংশ নদীর পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের নদনদীগুলো বিপদসীমা অতিক্রম করার অনেক আগেই উজান থেকে আসা পাহাড়িয় ঢল ও অতিবৃষ্টির কবলে সিলেট-সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চলের মানুষ গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। প্রথমে মেঘালয় থেকে আসা ঢলে উঠতি বোরো ধান ডুবে গিয়ে সেখানকার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের আঘাত হানে। বোরো ধানের বাইরে হাওরাঞ্চলে মৎস্যই হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত। ভারতের পাহাড় থেকে আসা আকষ্মিক ঢলে প্রায় প্রতিবছরই হাওরাঞ্চলের কৃষকদের ফসল হারাতে হয়। এবার একসাথে লক্ষাধিক হেক্টর বোরো ধান বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার টন মাছও মরে যায়। মাছসহ নানা প্রকার জলজ প্রানী, হাঁস, পশু-পাখিও মড়কের শিকার হয়। আসামের পাহাড়ে বিদ্যমান ভারতের কথিত ইউরেনিয়াম খনি থেকে আসা রাসায়নিক দূষনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলে এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে বলে অনেকেই দাবী করলেও সরকারের তরফ থেকে বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা দেখা গেছে। বন্যায় ধানক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় ধানগাছের পচন থেকে সৃষ্ট গ্যাস থেকে মাছের মড়কের জন্য দায়ী বলে কোন কোন সরকারী বিশেষজ্ঞ দাবী করলেও তাদের এমন দাবীর সপক্ষে কোন তথ্যভিত্তিক প্রমান আমরা এখনো পাইনি। ইতিমধ্যে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও এসব কমিটির রিপোর্ট সম্পর্কে শুরুতেই জনমনে অনাস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। এরপর গত তিনমাসেও হাওরে অস্বাভাবিক পানিদূষণ এবং হাজার হাজার টন মাছসহ জলজ প্রানী মড়কের নেপথ্য কারণ সম্পর্কে সরকারের তরফ থেকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ঘটনা যা’ই ঘটে থাকুক হাওরের ফসলহানি এবং এবার পানিদূষণে হাওরের প্রাণ-প্রকৃতির উপর বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসার মধ্য দিয়ে আমাদের পানি ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরো প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। সেই সাথে উজানের ঢলে প্রতিবছরই বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধগুলো ভেঙ্গে তলিয়ে যাওয়ার পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক শ্রেনীর কর্মকর্তার দুর্নীতি, কারসাজি ও কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি আবারো প্রমানীত হয়েছে। হাওরে অকাল বন্যা, ফসলহানির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টরাও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের উপর দায় চাপিয়েছেন। তবে এ পর্যন্ত যেন তাদের দায় শেষ, লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ, লাখ লাখ টন খাদ্যসশ্য পানিতে তলিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কখনো কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়না বলেই স্বাধীনতার পর থেকে দেশের পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশকে বন্যা, জলাবদ্ধতা ও ফসলহানির বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিলেও কর্তাব্যক্তিরা কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে শান শওকতের মধ্যে গর্বিত জীবন যাপন করছেন।
দুই মাস ধরে ঢাকা শহরে চিকুনগুনিয়া জ্বরের প্রাদুর্ভাব চলছে। লক্ষাধিক মানুষ এই জ্বরে আক্রান্ত হলেও সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তারা একে মহামারি বলে আখ্যায়িত করতে রাজি নন। তারা মহামারির তাত্তি¡ক সংজ্ঞা উপস্থিত করে সাধারণ মানুষের দাবী নাকচ করে দিচ্ছেন।মূলত এডিস মশার কামড়ে ছড়িয়ে পড়া ভাইারাসজণিত রোগ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা মাসের পর মাস ধরে তীব্র যন্ত্রনাসহ শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। যে শ্রমিকের প্রতিদিনের উপার্জনে তার সংসার চলে সে যদি মাসব্যাপী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে থাকে, তার সংসার চলে কি করে? ইতিমধ্যে হাইকোর্টের এক রায়ে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের ক্ষতিপুরণ দেয়ার নির্দেশও এসেছে। শহরের মশক নিধনে ব্যর্থতা ও চিকুনগুনিয়ার মত নাগরিক দুর্ভোগের জন্য ঢাকার দুই মেয়রকে এখন লালকার্ড দেখাচ্ছেন নগরবাসি। হাজার হাজার পেশাজীবী, ব্যবসায়ীর পেশা ও ব্যবসায় চিকুনগুনিয়ার কারণে লাটে উঠার উপক্রম হয়েছে। চিকুনগুনিয়ায় মানুষের মৃত্যুঝুঁকি না থাকলেও এর ফলে পরোক্ষভাবে দেশের শত শত কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। হঠাৎ করে একসঙ্গে হাজার হাজার মানুষ চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার নেপথ্য কারণ সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠতে দেখা যাচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই শহরে পানিবদ্ধতা, পয়োনিষ্কাশন, পরিচ্ছন্নতাসহ নানা ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগের জন্য ঢাকার মেয়রসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার অভিযোগের পাশাপাশি এ ধরনের মহামারির পেছনে জীবানু হামলা বা বায়োলজিক্যাল কনটেমিনেশনের সন্দেহ প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। হঠাৎ করেই ঢাকা মশার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়নি। তবে একসঙ্গে হাজার হাজার মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় এমন প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া অস্বাভাবিক নয়। চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব এখন ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানেও ছড়িয়ে পড়েছে। চিকুনগুনিয়ায় এখনো কারো মৃত্যু না হলেও একই সময়ে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে অজ্ঞাত রোগে অন্তত ১০ শিশুর মৃত্যু এবং শতাধিক মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সীতাকুন্ডে শিশুমৃত্যু সহ আক্রান্ত রোগির সংখ্যা বেড়ে চলার সাথে সাথে গত কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমে একে অজ্ঞাত রোগ হিসেবে তুলে ধরা হলেও দেশের রোগতত্ত¡ বিভাগসহ সংশ্লিষ্টরা প্রকৃত তথ্য খুঁেজ বের করার কোন উদ্যোগ নিয়েছে বলেও জানা যায়না। দেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন নানাভাবে চরম হুমকির সম্মুখীন হওয়ার পরও সরকারের সংশ্লিষ্টদের নিস্ক্রিয়তা, দায়হীনতার কারনে জনমনে আতঙ্ক, আশঙ্কা, সন্দেহ ক্রমে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় পরিনত হচ্ছে। ক্লিন ঢাকা, গ্রীন ঢাকা ইত্যাদি শ্লোগান নিয়ে ঢাকার মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে সরকারী দলের টিকিটে ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহনের পর ঢাকায় অপরিচ্ছন্নতা, পানিবদ্ধতা, যানজটের মত নাগরিক দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এডিস মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া মহামারি আকার ধারণের পর এক মেয়রের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের একটি অংশ রাস্তায় লালকার্ড প্রদর্শন করেছে। ঘরে ঘরে গিয়ে মশা মারা বা মশারি টানিয়ে দেয়ার দাবী মেয়রের কাছে কেউ করেছেন কিনা আমরা জানিনা। এতটা আশা করাও সমীচিন নয়। তবে রাস্তায় নর্দমা, সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটুপানির বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাওয়া নগরবাসির সাধারণ নাগরিক অধিকার। এই অধিকার নিয়েও কেউ রাজপথে নামেনি। তবে এডিস মশার কারনে হাজার হাজার মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পরও মেয়রদের দায় এড়ানোর অপচেষ্টায় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসতেই পারে।
সাধারণত বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নানা ধরনের পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। এবার তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। ঢাকায় চিকুনগুনিয়ার কথা বাদ দিলেও সারাদেশে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার আগেই নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে। কোথাও কোথাও সাধারণ জ্বরেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। রাজশাহীতে জুলাই’র প্রথমার্ধে অন্তত ২০ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। অন্যদিকে ঠাকুরগাঁও জেলায় এডিস ও কিউলেক্স মশাবাহিত জীবাণু সংক্রমনে ফাইলেরিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। আর বানভাসি চরাঞ্চলের মানুষ মশাবাহিত রোগের পাশাপাশি নানা ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানা যায়। তবে আবহাওয়া ও রোগতত্ত¡ বিশেষজ্ঞরা দেশে নানা ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য আগাম বর্ষাসহ জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও উপসর্গসমুহ সম্পর্কে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা আমাদের মত দেশগুলোর জন্য দীর্ঘদিন ধরেই সতর্কবানী প্রচার করে আসছেন। দেশের উপকুলীয় বিশাল এলাকা প্লাবিত হয়ে কয়েক কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিনত হওয়ার মত আগাম সতর্কতা আমাদের সরকারের জন্য যেন তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বিশেষত: ভুল পরিকল্পনায় অবকাঠামো উন্নয়নের নামে পরিবেশগত ভারসাম্য বিনাশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের উপসর্গগুলোকে ত্বরান্বিত করার প্রতিযোগিতায় যেন লিপ্ত রয়েছে সরকার। এক সময় জাতিসংঘ ঘোষিত মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল(এমডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে কয়েকটি সুচকে বাংলাদেশ প্রত্যাশিত সাফল্য দেখাতে সক্ষম হলেও পরিবেশগত বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় উন্নয়নের সাবেক ধারনা এখন পাল্টে গেছে। এখন পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের রূপরেখা নিয়ে এগুতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে এর নাম দেয়া হয়েছে এসডিজি বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল। এমডিজি’র মত এসডিজি অর্জনেও বাংলাদেশ রোল মডেল হতে চায় বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও গত সপ্তাহে জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসডিজি অর্জনে প্রস্তুতি গ্রহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়েও অনেক পিছিয়ে আছে। এসডিজি’র ১৭টি সূচকের মধ্যে ১০টিতেই বাংলাদেশ রেডলাইন অতিক্রম করতেও ব্যর্থ হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বিশ্বের ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। এ তালিকায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১২২ ও ১৫০তম হলেও ভারত(১১৬), শ্রীলঙ্কা(৮১), ভ’টান(৮৩), নেপাল(১০৫) মিয়ানমার(১১০) বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে আছে। অথচ আমাদের সরকার গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে দেশকে উন্নয়নের মহাসরনীতে তুলে দেয়ার গৌরবময় সাফল্য দাবী করছে। এ সপ্তাহে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ঢাকা সফরে এসে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি শক্তিশালী বিরোধিদলের প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন। আঞ্চলিক পরাশক্তি বিশাল ভারতের পাশে থেকে শ্রীলঙ্কা নানা দিক থেকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে অগ্রযাত্রা সফলভাবে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশও ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকার প্রমান দিয়েছে। কিন্তু দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, জননিরাপত্তা, সুশাসন, পানি ব্যবস্থাপনা তথা টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জসমুহ মোকাবেলায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে উন্নয়নের রোল মডেল হওয়ার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
হাওরে অকাল বন্যার পর সারাদেশে প্রলম্বিত বন্যায় লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এর ফলে দেশে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা বেড়ে চালের মূল্যে বড় ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করেছে। চাল আমদানীর উপর শুল্ক কমিয়ে দেয়ার পরও উর্ধ্বমূখী খাদ্যমূল্যে তেমন কোন ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছেনা। সরকারী গুদামে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ না থাকায় বন্যা উপদ্রæত অঞ্চলগুলোতে লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষকে ত্রাস সহায়তা দিতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। যেখানে আপদকালীন মজুদ হিসেবে সরকারী গুদামে কমপক্ষে ১০ লাখ টন খাদ্য মুজদ থাকার কথা সেখানে চলতি মাসের শুরুতে চালের মজুদ একলাখ টনে নেমে আসার খবর প্রকাশিত হয়েছে। ইতিপূর্বে এক-এগারোর সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও দেশের বড় ধরনের খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়ার সময় প্রতিবেশী ভারত হঠাৎ করেই বাংলাদেশে চাল রফতানী বন্ধ করে দিয়েছিল। এবারো দেশব্যাপী বন্যায় খাদ্য ঘাটতির মুখে ভারত চালের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানা যায়। একদিকে খাদ্য মন্ত্রী বলছেন দেশে কোন খাদ্য ঘাটতি নেই, ত্রাণমন্ত্রী বলছেন ত্রাণের কোন অভাব হবেনা। অথচ প্রায় প্রতিদিনই হাজার হাজার বর্ন্যাত মানুষের ত্রাণ বা খাদ্য সহায়তা না পাওয়ার চিত্র প্রকাশিত হচ্ছে। তবে ভিয়েতনাম থেকে প্রায় আড়াই লাখ মেট্টিক টন চাল আমদানীর যে প্রক্রিয়া চলছে সেই প্রক্রিয়ায় প্রথম দুই চালানে ৪৭ হাজার টন চাল চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌছেছে বলে জানা গেছে। তবে বেসরকারী উদ্যোগে চাল আমদানীর পরিমান নি:সেন্দেহে আরো অনেক বেশী। বেশ কয়েক বছর ধরেই সরকার দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন করার কৃতিত্ব জাহির করছে, একই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চালের মূল্য। আর এখন দেখা যাচ্ছে দেশের সরকারী খাদ্য গুদামগুলোতে চালের মজুদ সাম্প্রতিক অতীতের যে সময়ের চেয়ে তলানিতে অবস্থান করছে। শুধুমাত্র হাওরের অকাল বন্যায় অন্তত ১০ লাখটন চালের উৎপাদন ব্যহত বা বিনষ্ট হয়েছে। অত:পর উত্তরের ধান উৎপাদনের জেলাগুলোতে বন্যা, ব্লাস্ট রোগে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এবারের বন্যায় শুধুমাত্র ধান উৎপাদনে ক্ষতির পরিমান অন্তত কয়েক মিলিয়ন টন। বর্তমানে প্রতি কেজি মোটা চালের সর্বনিম্ন মূল্য ৪০ টাকা হিসেবে প্রতিটন চাল ৪০ হাজার এবং ১০ লাখ টন চালের মূল্য দাড়ায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এটি শুধু ধানক্ষেত তলিয়ে যাওয়ার আংশিক হিসাব মাত্র। বাংলাদেশে অকাল বন্যা, পাহাড়িয়া ঢল ও নদী ভাঙ্গনের আর্থ-সামাজিক ক্ষতির পরিমান আরো বহুগুন বেশী। ঢাকা- চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটান সিটি থেকে শুরু করে যশোরের ভবদহ বিলকাপালিয়ার পানিবদ্ধতা এবং নদী ভাঙ্গনের ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের দাবী উপেক্ষা করেই সরকার তথাকথিত উন্নয়নের নামে বছরে লক্ষকোটি টাকার বাজেট খরচ করছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের বেশীরভাগই সর্বত্র পানিবদ্ধতা ও বন্যার প্রকোপ বাড়িয়ে তুলছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশগত সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে সরকার শহরে ফ্লাইওভার নির্মান এবং পদ্মাসেতুর মত মেগাপ্রকল্পে অর্থনৈতিক সামর্থ্যের পুরোটাই নিয়োজিত করে চলেছে। শহরের রাস্তা পানিবদ্ধতা নিরসন, নদনদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত সুপরিকল্পিত ও টেকসই বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ নির্মানে গুরুত্ব দেয়া হলে জাতিকে এমন দুর্ভোগ দুর্দশার সম্মুখীন হতে হতোনা। বহুদিন ধরেই দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্টের উপর গুরুতা¡রোপ করে আসছেন। অন্যদিকে ভারতের অব্যাহত পানি আগ্রাসন ঠেকাতে অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে। শুকনো মওসুমে যৌথ নদীর সব পানি আটকে রেখে এবং বর্ষাকালে গঙ্গা ও গজলডোবা ব্যারাজের সবগুলো স্লইস গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারার এই ভারতীয় চক্রান্ত চলতে দেয়া যায়না। সন্দেহ নেই যে, পদ্মাসেতু দেশের দক্ষিনাঞ্চলের মানুষের একটি বড় স্বপ্ন। তবে ফারাক্কা ব্যারাজের বিপক্ষে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মানের মাধ্যমে দেশের পানি ব্যবস্থাপনায় নিজেদের সামর্থ্য গড়ে তোলার পদক্ষেপ পদ্মা সেতুর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একইভাবে সারাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধগুলোর উন্নয়ন ও সংস্কার, নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ, শহরের স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার উন্নূয়ন ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ন। সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা ও নোংরা পানিতে কোটি কোটি মশা উৎপাদনকারী শহরে যখন লাখ লাখ মানুষ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মহামারিতে আক্রান্ত তখন শহরের এপাশ ওপাশ বেষ্টিত ফ্লাইওভারের চাকচিক্য নগরবাসির কাছে কোন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনা। শুকনো মওসুমে নদীতে পানি না থাকলেও বর্ষায় নদীভাঙ্গনে বছরে লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়। এসব উদ্বাস্তু মানুষ ঢাকায় এসে বস্তিগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ঢাকা নগরীকে বাসযোগ্য রাখতে এবং কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রয়োজনে বন্যা নিয়ন্ত্রন ও পানি ব্যবস্থাপনাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকারমূলক জাতীয় প্রকল্প হিসেবে গ্রহন করতে হবে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন