তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি জানানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারা প্রচলিত আইনের সঙ্গে সংঘর্ষিক ও সাংবিধানিক আইনের পরিপন্থী। ধারাটি বাকস্বাধীনতা ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার পথে মস্তবড় বাধা বা অন্তরায়। ২০১৩ সালে সংশোধনের পর থেকে ৫৭ ধারার ব্যাপক প্রয়োগ হচ্ছে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা এই ধারায় নানাভাবে হয়রানি ও জুলুমের শিকার হচ্ছে। এ পর্যন্ত বহু সাংবাদিককে এ ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে, জেলে নেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিককালেও ডজনাধিক মামলা এই ধারায় হয়েছে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকারবাদী সংগঠনগুলো সেই শুরু থেকেই ধারাটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। এই প্রেক্ষিতে সরকারের তরফে কখনো বলা হয়েছে, ধারাটি বাতিল করা হবে, কখনো বলা হয়েছে, সংশোধন করা হবে, কখনো বলা হয়েছে, নতুন আইন করা হবে। বস্তুত, এই ধারা বাতিলের ব্যাপারে দেশে যে একটি সাধারণ ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, সম্ভবত সরকারও তা এড়িয়ে যেতে পারেনি। এ কারণে সরকারের বক্তব্যের মধ্যে এই বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। এমতাবস্থায়, সকল মহলেই হয়তো এমন একটি ধারণা সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে, সরকার ধারাটি বাতিল বা সংশোধন করবে এবং নতুন আইনে অনুরূপ কোনো ধারা সংযোজন থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তাদের এই ধারণা চরমভাবে মার খেতে বসেছে। জানা গেছে, প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৫৭ ধারার অনুরূপ ধারা থাকছে। ৫৭ ধারার চেয়েও সে ধারা কঠিন। এমন কি অনলাইন গণমাধ্যম বিষয়ক খসড়া আইনেও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিষয়গুলো থাকছে। বুঝা যাচ্ছে, সরকার ৫৭ ধারাটি যেভাবেই হোক রেখে দিতে চাইছে এবং এতে তার অনাকাক্সিক্ষত ফায়দা উঠিয়ে নেয়ার মনোভাব পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হচ্ছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন থেকে ৫৭ ধারা হয়তো বিলুপ্ত হবে। কিন্তু অন্য আইনে ভিন্ন ধারায় ওই ৫৭ ধারাটি থেকে যাবে, কিংবা ধারাটি আরো কঠোর হবে, এই আলামত স্পষ্ট হওয়ার প্রেক্ষাপটে, সম্পাদক পরিষদ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে এবং অন্য আইনে এ ধারাকে সংযোজন না করার আহŸান জানানো হয়েছে। সম্পাদক পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্পাদক পরিষদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রস্তাবিত খসড়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এই আইনের খসড়ায় ১৯ ধারায় বিদ্যমান তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার সব বিষয় বিদ্যমান থাকায় আমরা উদ্বিগ্ন। এই ১৯ ধারাতেও তথাকথিত মানহানি, সামাজিকভাবে অপদস্ত করার চেষ্টা বিশেষভাবে রাখা হয়েছে। যদিও আইনমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ৫৭ ধারাটি থাকছে না। কিন্তু প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯ ধারাতে আরও শক্তভাবে তা রাখা হচ্ছে। আমরা এটা ভেবেও উদ্বিগ্ন যে, প্রস্তাবিত খসড়ার ১৫ (৫) ধারা চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আরেকটি বড় বাধা হবে। কারণ, এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কোনো বক্তব্য সরকারি বক্তব্যের বিপরীত হলে তা ‘ডিজিটাল সন্ত্রাসী অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক বিধান পর্যালোচনা ও সংশোধন করে দেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনার সুযোগ করে দিতে আমরা সরকারের প্রতি আহŸান জানাচ্ছি। সম্পাদক পরিষদ অনলাইন গণমাধ্যম বিষয়ক নীতিমালার খসড়া নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এতে ৫৭ ধারাসহ তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিধানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতেও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কথিত মানহানিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে নেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অন্তরায় হয় এমন সব বিধিবিধান বাদ দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহŸান জানাচ্ছে। সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দিয়ে বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, সরকারের কোনো নীতিমালা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম, তাদের সংশ্লিষ্ট ডিজিটাল মিডিয়া তথা ওয়েবসাইট, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনোরকম হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য হবে না। সব শেষে সম্পাদক পরিষদ এই মর্মে দাবি ও অভিমত প্রকাশ করেছে, আইসিটি আইন থেকে ৫৭ ধারা সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে এবং কোনো নতুন আইনে এই ধারাগুলো পুন:প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া থেকে বিরত থাকুন। কেননা এই আইনের ধারাগুলো সংবিধানপরিপন্থী এবং সংবিধানে রক্ষিত স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সংবাদিকতার প্রতি হুমকি।
সম্পাদক পরিষদের বক্তব্যের পর আমাদের আর বলার তেমন কিছু নেই। শুধু এটুকু বলতে চাই, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা একটি কালো আইন হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে এই ধারাটির বিলোপ ও এর প্রয়োগ এখনই বন্ধ ঘোষণা করা আবশ্যক এবং অন্য আইনে এই ধারার সংযোজন থেকে বিরত থাকার বিকল্প নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য একটি আইন থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেই আইনের নামে বা তাতে এমন ধারা বা বিধান থাকা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করবে এবং ভিন্নমতের মানুষের হয়রানি ও জুলুমের শিকারে পরিণত করবে। এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৫ সালের ২৪ মার্চ এক রায়ে সে দেশের আইসিটি আইনের ৬৬ (ক) ধারা, যা ৫৭ ধারার অনুরূপ, বাতিল করে দেন। রায়ে বলা হয়, ৬৬ (ক) ধারা অসাংবিধানিক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথে একটি বাধা। অতএব, আমরা আশা করব, ৫৭ ধারা রেখে দেয়ার যে প্রক্রিয়া চলছে, সরকার সেই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসবে। মনে রাখতে হবে, এই ধারা এবং তার যথেচ্ছ প্রয়োগ সরকারের ভাবমর্যাদার জন্য কোনোভাবেই কোনোদিক দিয়েই অনুক‚ল নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন