সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল

| প্রকাশের সময় : ২৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত পরশু। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডসহ মোট ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১১ লাখ ৬৩ হাজার ১৭০ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে পাস করেছে ৮ লাখ ১ হাজার ২৪২ জন। পাসের হার ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। গত ১০ বছরের মধ্যে এটা পাসের সর্বনিম্ন হার। শুধু পাসের হারের ক্ষেত্রে নয়, ফলাফলের সব সূচকেই অবনমন ঘটেছে। জিপিএ-৫ এর হার কমেছে। শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে। শূন্য পাসের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাসের হার সিলেট বোর্ডের, সর্বনিম্ন কুমিল্লা বোর্ডের। এদের পাসের হার যথাক্রমে ৭২ শতাংশ ও ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। বাকি বোর্ডগুলোর পাসের হার ৬১ শতাংশ থেকে ৭১ শতাংশের মধ্যে। ১০ বোর্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ পাসের হার কারিগরি বোর্ডের-৮১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, যার পাসের হার ৭৭ দশমিক ০২ শতাংশ। সব কিছুর বিবেচনায় পাসের হারে এক ধরনের বিপর্যয় লক্ষ্য করা গেলেও অনেকেই মনে করেন, খাতা মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতির কারণেই এরকম ফলাফল হয়েছে। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীও এ মতই পোষণ করেন। তিনি মনে করেন, এটা ইতিবাচক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, কত শতাংশ পাস করেছে, সেটা বড় বিষয় নয়। শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় মনোযোগী হতে হবে এবং এই বয়সে তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সঠিক গাইডলাইন দেয়া। পাস-ফেল নিয়ে না ভেবে শিক্ষার মান বাড়াতে নজর দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের যথার্থতা প্রশ্নাতীত। গত কয়েক বছরে পাসের হারে যে ধারাবাহিক উল্লম্ফন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তা সহজভাবে নেয়ার মতো নয়। নমনীয়ভাবে খাতা মূল্যায়নের মাধ্যমে পাসের হার বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা কেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে দেখা দিয়েছিল, আমরা জানি না। তবে এতে লেখাপড়ার একরকম সর্বনাশ হয়েছে তা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা অকল্পনীয়ভাবে বাড়লেও দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা হয়নি। তাদের বেশিরভাগই উচ্চতর শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এমন তথ্যও আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দু-একজন ছাড়া কেউই উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এটা শিক্ষার শোচনীয় অবমানই প্রমাণ করে। পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার মানে তার কোনো প্রতিফলন না ঘটায় সর্বমহলে একটা উদ্বেগ ও বিচলন রয়েছে। এমতাবস্থায়, গত বছর খাতা মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। এরই ফলে পাসের হারে লাগাম পড়েছে।
একে আমরা শিক্ষামন্ত্রীর মতোই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চাই। এই সঙ্গে এই প্রশ্নও আমাদের রয়েছে, শিক্ষার গুণগত মান কি বাড়ছে? সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও পদক্ষেপ কি নেয়া হয়েছে? আমরা নৈতিক, সৃজনশীল ও কর্মোপযোগী শিক্ষা চাই। সে ব্যাপারে উদ্যোগ-পদক্ষেপের নিশ্চিত ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠ্যক্রম, পাঠ পদ্ধতি, খাতা মূল্যায়ন ইত্যাদি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এসবের ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হলে উপযুক্ত শিক্ষক যেমন দরকার তেমনি তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণও অপরিহার্য। বাস্তবতা এই যে, উপযুক্ত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের নিদারুণ অভাব রয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক স্কুলে রয়েছে শিক্ষকের সঙ্কট। কলেজ পর্যায়েও একই কথা প্রযোজ্য। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে লেখাপড়া তেমন একটা হয়না। এ ব্যাপারে নজরদারি ও জবাবদিহিতা বলেও কিছু নেই। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করানোর উদ্যোগ-প্রক্রিয়াও দৃশ্যমান নয়। শিক্ষার্থীরা প্রকৃত জ্ঞানার্জনের বদলে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করাকেই লক্ষ্য-মোক্ষ হিসেবে নির্ধারণ করে নিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা সহযোগী হিসেবে পেয়েছে কোচিং সেন্টারগুলোকে। কোচিং সেন্টার ও গাইড বই শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ সরিয়ে দিচ্ছে। এসব নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, অনেক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ফলাফল শূন্য। সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোযোগী করা কিংবা শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ, সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী- সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ ও তৎপরতার মাধ্যমেই শিক্ষার কাক্সিক্ষত গুণগত মান বৃদ্ধি সম্ভবপর হতে পারে।
আমরা সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষা চাই না। আমরা সার্টিফিকেটধারী অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়াতে চাই না। আমরা চাই উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষা এবং প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ। অনেকেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। বস্তুত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তখনই হবে যখন মানসম্পন্ন শিক্ষার নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং শিক্ষার্থীরা জ্ঞান চর্চাকে শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করবে। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের নৈতিকতামুখী, জ্ঞানমুখী ও কর্মমুখী করে গড়ে তুলতে হবে। উচ্চমানসম্পন্ন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিসারী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের হয়তো আরো সময় দিতে হবে, আরো পথ হাঁটতে হবে। এ ব্যাপারে পিছপা হলে চলবে না। জ্ঞানভিত্তিক সমাজই বলি আর শিক্ষিত জাতিই বলি, একদিনে গড়ে উঠবে না। এ জন্য নিরন্তর প্রয়াস ও সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। পরিশেষে এবারের পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছে আমরা তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। যারা অকৃতকার্য হয়েছে তাদের প্রতি রইল সমবেদনা। আমরা আশা করি, আগামীতে তারা কৃতকার্য হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
MD.PARVEZ HOSAIN ২৫ জুলাই, ২০১৭, ১০:৫৫ এএম says : 0
NEED TO MORE IMPROVE
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন