কয়েক ঘন্টার মাঝারি বৃষ্টিপাতে ঢাকা শহর পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন না হলেও বৃষ্টিতে এবং জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রাম শহর তলিয়ে যাওয়া নতুন অভিজ্ঞতা। এবার বর্ষার শুরুতেই আগাম বৃষ্টিপাত এবং জোয়ারে চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় কোথাও কোথাও বুকপানিতে তলিয়ে গেছে। এসব রাস্তায় এখন সড়ক পরিবহনের বদলে নৌকা চলছে। শহরের কর্মজীবী মানুষ কর্মস্থলে পৌছতে নৌকায় চড়তে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ নিজেই নৌকা নিতে নিয়েছেন বলেও পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। এমনিতেই বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ না থাকায় সামুদ্রিক জোয়ারের পানি সরাসরি শহরের খালগুলো উপচে রাস্তায় উঠে যাচ্ছে, সেই সাথে গত কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষনে চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ব বানিজ্যকেন্দ্র ও রাস্তাগুলো স্থায়ী পানিবদ্ধতার শিকার হয়েছে। দেশের প্রধান বন্দর নগরী এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের গেটওয়ে চট্টগ্রামের এই পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিও ব্যবসায় বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। দেশের জন্য ভোগ্যপণ্য আমদানী ও পাইকারী বিক্রেতাদের শত শত আড়ত ও গোডাউন সমৃদ্ধ এলাকা খাতুনগঞ্জ, চাকতাই ও আসাদগঞ্জ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার বাস্তবতা দীর্ঘায়িত হলে তা’ দেশে নতুন করে মূল্যস্ফীতি ঘটাতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। জোয়ারে তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অতিবর্ষনে পাহাড় ধসের আশঙ্কা চট্টগ্রাম নগরীর জন্য বাড়তি বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
দেশের সরকার এবং রাজনীতিবিদরা যখন উন্নয়নের জোয়ারের কথা বলছেন, তখন রাজধানী শহর এবং প্রধান বন্দর নগরী অস্বাভাবিকভাবে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মান করা হলেও শহরকে জঞ্জালমুক্ত, পানিবদ্ধতামুক্ত এবং বন্যামুক্ত রাখতে দৃশ্যত তেমন কিছুই করা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে এমনকি সিলেট শহরও অবিরাম বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতার শিকার হওয়ার চিত্র দেখা গেছে। গত চার দশক ধরে অনিয়ন্ত্রিত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে শহরের আয়তন ও চাকচিক্য বাড়লেও বর্ধিত শহরের পরিবেশগত নিরাপত্তার বিষয়ে নগর কর্তৃপক্ষের অবহেলাই আজকের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। শহরের চারপাশের নদী, নিম্ন জলাভূমি, অভ্যন্তরের খালগুলো ভরাট ও দখল হওয়ার কারনেই শহরগুলো এমন বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। নগর পরিককল্পনাবিদ ও পরিবেশবাদিরা দীর্ঘদিন ধরেই এসব বিষয়ে কথা বলছেন। ঢাকার হারিয়ে যাওয়া, দখল ও ভরাট হওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার কথাও বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। একইভাবে চাক্তাই খালসহ চট্টগ্রাম শহরের খালগুলো সংস্কার, পুনরুদ্ধার এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের উন্নয়নের প্রসঙ্গ বার বার আলোচিত হলেও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবতা লাভ করেনি। ঢাকা চট্টগ্রামের মেয়ররা নির্বাচনের আগে অনেক গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নির্বাচিত হওয়ার পর সরকার তাদেরকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় উন্নীত করলেও নগরীর মৌলিক উন্নয়নের তাদের এবং সরকারের ভূমিকা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষত: ঢাকা নগরীকে পানিবদ্ধতামুক্ত রাখতে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে ভরাটমুক্ত ও সংস্কার করার পাশাপাশি স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন ছিল তা’ হয়নি বলেই এখন শহরের রাস্তায় নৌকা চলছে।
গত কয়েক বছর ধরেই ঢাকা নগরী বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম সারিতে স্থান পাচ্ছে। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরেও রাজধানী ঢাকা শহরের জন্য কোন আধুনিক নগর পরিকল্পনা গৃহিত হয়নি। চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্ন বিভাগীয় ও জেলাশহরগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে দ্রুত বর্ধনশীল নগর জীবন মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। আমরা যখন আগামী দশকে একটি মধ্য আয়ের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। সেই সাথে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের রূপরেখা অনুসরনেরও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি তখন আমাদেরকে অবশ্যই পরিবেশবান্ধব বাস্তু, নগরায়ণ ও শিল্পায়ণের দিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে অপরিকল্পিতভাবে গৃহিত হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নগরীগুলোকে একসময় বসবাসের অযোগ্য করে তুলতেই বেশী ভূমিকা রাখবে। আমরা যখন আর মাত্র কয়েক বছর বাদেই সাড়ম্বরে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি উদযাপন করতে যাচ্ছি, তখন আমাদের রাজধানী এবং বন্দর নগরী পরিত্যক্ত নগরীতে পরিনত হওয়ার বাস্তবতা মেনে নেয়া যায়না। ঢাকা ও চট্টগ্রামকে এই ডুবন্ত অবস্থা থেকে রক্ষা করতে অনতিবিলম্বে অগ্রাধিকার ভিত্তিক সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষত: শহরের চারপাশের নদীগুলোর সংস্কার, খাল পুনরুদ্ধার, বন্যানিয়ন্ত্রণ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মত শহরের জন্য স্বাধীণ ও দক্ষ নগর সরকারের দাবী বিবেচনায় আনতে হবে। নগরীর রাস্তায় পানিবদ্ধতা, যানজট, যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুড়ির দুর্ভোগ লাঘবে ওয়াসা, ডেসা, টিএন্ডটিসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকান্ডে সমন্বয় গড়ে তোলা প্রয়োজন। বৃষ্টির পানিতে শহরের রাস্তা ও বাড়িঘর তলিয়ে লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগের দায় সংশ্লিষ্টদের বহন করতে হবে। এই দুর্যোগ থেকে শিক্ষা নিয়ে নগরীগুলোকে বাসযোগ্য করে তুলতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে। এটাই সকলের প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন