শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বঙ্গোপসাগরে ইলিশ লুণ্ঠন ও দস্যুতা বন্ধ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বঙ্গোপসাগরের বিশাল মৎস্যভান্ডার এবং খনিজ সম্পদের হাতছানি লক্ষ্য করে বাংলাদেশকে সবুজ ব্ল ইকোনমির বিপুল সম্ভানাময় দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছেন দেশি-বিদেশি সমুদ্র বিশেষজ্ঞরা। সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে ইলিশই এখন প্রধান অর্থনৈতিক খাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ ও আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের নদনদীগুলো ব্যাপক অংশে নাব্যতা হারালেও সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের ফলে গত তিন দশকে দেশে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুন হয়েছে। আমাদের সমুদ্রোপকুলের বিপুল সম্ভাবনাময় খনিজ সম্পদ ছাড়াও ইলিশসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মৎস্য আমাদের অন্যতম অর্থনৈতিক খাত এবং দেশের খাদ্য ও আমিষের চাহিদা পুরণে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। জাটকা ধরা নিষিদ্ধ করা, প্রজনণ মওসুমে মা মাছ ধরা বন্ধে বিশেষ নজরদারি এবং জেলেদের প্রণোদনা সহায়তা দেয়ার ফলে ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও সমুদ্রে জেলেদের নিরাপত্তা এবং বিদেশি জেলেদের মাছ লুণ্ঠন বন্ধ করা গেলে ইলিশ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন আরো কয়েক লাখ টন বৃদ্ধি পেত। বিশেষ ভূ-প্রাকৃতিক কারণে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ উপকুল এবং বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ইলিশের প্রাকৃতিক ভান্ডারে সমৃদ্ধ। এ কারণেই এই অঞ্চলে মাছ ধরা এবং বাংলাদেশি জেলেদের ধরা মাছ লুণ্ঠনে লিপ্ত রয়েছে ভারতীয় জেলে, নৌ-দস্যু ও চোরাচালানিরা। প্রথমত: ওরা অত্যাধুনিক জাল ও বড় ট্রলার নিয়ে বাংলাদেশি নৌসীমায় ঢুকে অবাধে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত: ভারতীয় নৌদস্যুরা বাংলাদেশি জেলেদের ধরা মাছ লুটে নিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেনা, জেলেদের সমুদ্রে ছুড়ে ফেলছে অথবা লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছে। তৃতীয়ত: আন্তদেশীয় চোরাচালানিরা জেলেদের জিম্মি করে ইলিশ নিয়ে যাচ্ছে এই সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমার থেকে ফেন্সিডিল, ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
গত মধ্য জুলাই থেকে সাগরে ইলিশ ধরার মওসুম শুরু হলেও এখনো বাজারে ইলিশের দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। হাজার হাজার জেলেনৌকা সাগরে ইলিশ ধরতে মেমে পড়েছে। গত ভরাকটালে ব্যাপক ইলিশ ধরা পড়ার সম্ভাবনার কথাও বলেছিলেন জেলে এবং মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। সাগরের প্রতিটি মোকামে ইলিশ ধরা পড়ার আশাপ্রদ খবরও পাওয়া যাচ্ছিল। ব্যাপক ইলিশ ধরা পড়ায় বাজারে যোগান বৃদ্ধির সাথে সাথে দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে চলে আসবে, এটাই স্বাভাবিক ধারনা। কিন্তু ব্যাপক ইলিশ ধরা পড়ার খবরের সাথে ঢাকার বাজারের চিত্র মোটেই যেন মিলছেনা। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, ইলিশের ভরা মওসুমেও বাংলাদেশের জেলেরা ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ ও দস্যুতার কারণে অবাধে ইলিশ শিকার করতে পারছে না। এ কারণেই ইলিশের ভরা মওসুমে বাজারে দাম কমছেনা। বর্তমানে প্রতি কেজি ইলিশের দাম গত বছরের তুলনায় ১ থেকে ৩শ’ টাকা বেশী। এক সময়ের বর্গি লুটেরাদের মতই ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর নৌদস্যু ও জেলেরা আমাদের মৎস্য সম্পদ লুটে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নৌ বাহিনী, কোষ্টগার্ডের অপ্রতুল নজরদারি ও টহল ব্যবস্থার ফাঁক-ফোঁকড় গলিয়ে বছরের পর বছর ধরে সাগরে লুটতরাজ ও দস্যুতা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশের জেলে ও নৌদস্যুরা।
সাগরের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রথমে মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও আহরণের দিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও নজর দিতে হবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বছরে হাজার কোটি টাকার মৎস্যসম্পদ বিদেশি জেলে এবং নৌদস্যুদের হাতে লুণ্ঠিত হওয়ার বাস্তবতা মেনে নেয়া যায়না। সাগরের বøু ইকোনমি নিয়ে সরকার অনেক আশাপ্রদ সম্ভাবনার কথা শোনালেও বিদেশি নৌদস্যুদের হাতে জেলেদের নিরাপত্তাহীনতা এবং মৎস্যসম্পদ লুণ্ঠনের বাস্তবতা বদলে দেয়ার কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। তবে সুন্দরবন এলাকাসহ দেশের উপকুলীয় নৌদস্যুতা রোধে কোস্টগার্ড ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বেশ কিছু সাফল্যজনক অভিযান পরিচালনা করেছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি বনদস্যু গ্রুপের কিছু সদস্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে অস্ত্র জমা দিয়েছে। দু’ বছর আগে বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযানে ৪৯টি বিদেশি ট্রলারসহ ৭৪২জন অনুপ্রবেশকারি জেলেকে আটক করা সম্ভব হয়েছিল। উল্লেখ্য, এর মধ্যে ৪২ টি ট্রলারই ছিল ভারতীয় জেলেদের। যেখানে বাংলাদেশি জেলেরা নিজ নৌসীমায় নিজেদের মৎস্য ভান্ডারে মাছ ধরতে পারছেনা সেখানে ভারত, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কান জেলেরা আমাদের নৌসীমায় অনুপ্রবেশ করে শুধু মাছ ধরেই নিয়ে যাচ্ছে না, তারা বাংলাদেশি জেলে নৌকায় লুণ্ঠন, হত্যাকান্ড চালিয়ে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরী করছে। প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখার প্রানান্ত চেষ্টা করে সফল হলেও শুধুমাত্র সমুদ্রসীমায় নিরাপত্তার অভাবে প্রতিবছর শত শত জেলেকে জীবন ও সহায়-সম্পদ হারাতে হচ্ছে। এ অবস্থা আর চলতে দেয়া যায়না। গরু চোরাচালানের অভিযোগে বাংলাদেশি নাগরিকরা সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে প্রান হারালেও মাদক চোরাচালানী, নৌদস্যু ও অনুপ্রবেশকারি জেলেদের বিরুদ্ধে তেমন কিছু করা হচ্ছেনা বলেই তাদের দৌরাত্ম্য কমছেনা। দেশের লাখ লাখ জেলে পরিবারের নিরাপত্তা, হাজার হাজার কোটি টাকার ইলিশ, মৎস্যসম্পদ এবং সাগরের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তা জোরদারে জরুরী ভিত্তিতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন