শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

থ্যালসেমিয়া মুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব

| প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শিশুদের অকালমৃত্যু নিয়ে গবেষণা করে ১৯২৫ সালে গবেষক টমাস কুলি দীর্ঘদিন প্রয়াসের পর ওদের মৃত্যুরহস্য আবিস্কার করেন। শুরুতে রোগটি চিহ্নিত হয়েছিল কুলির অ্যানিমিয়া নামে, পরে নাম রাখা হয় থ্যালাসেমিয়া। এটি একটি বংশগত রোগ, যার কারণে মানুষের হিমোগেøাবিন উৎপাদনে ঘাটতি থাকে। আসলে মানুষের জিনঘটিত অসঙ্গতির জন্য হিমোগেøাবিনের পরিমাণ কমে যায় আর সেজন্য রোগীর অকালমৃত্যু ঘটে থাকে। সাধারণত হিমোগিøাবিনে থাকা লোহিত রক্তকণার আয়ু প্রায় ১২০ দিনের মতো হয়ে থাকে। এই রোগে নতুব কণা সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু এদের আয়ু কম থাকে। এভাবে হিমোগেøাবিনের অভাবে রোগীর সমস্যা বেড়েই চলে। বর্তমানে চিকিৎসা পরিষেবায় উন্নতি হওয়ায় রোগীকে হোল বøাডের পরিবর্তে এক ইউনিট (১৮০ মিলিঃ প্রায়) লোহিত কণা (আরবিসি) সরাসরি রক্ত সঞ্জারণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এতে রোগীর কল্যাণ হলেও অন্যান্য কারণে রোগী ও তার অভিভাবকের সমস্যার অন্ত নেই। থ্যালাসেমিয়ার উৎপত্তি হয় গ্রিক শব্দ থ্যালাসা (সমুদ্র) থেকে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের লোকদের মধ্যে এই মারাত্মক রোগটি প্রথমে ধরা পড়ে পরে গোটা বিশ্বেই এর সন্ধান পাওয়া যায়।
হিমোগেøাবিনের পলিপেপটাইড শৃঙ্খলে বিটা বা আলফা চেইন তৈরি হয় না বা কম তৈরি হয় । এই অসঙ্গতির কারণে হিমোগেøাবিন অধঃপতিত হয় সঙ্গে সঙ্গে রক্তের লোহিত কণাও বিদীর্ণ হয়ে যায়। তখন হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়ার সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে লোহিত কণা ছোটো হয়ে ভেঙ্গে যায় সময়ের আগেই। এর প্রভাব পড়ে রোগীর শরীরে তাই বাইরে থেকে রক্ত সঞ্চারণ করে রোগীকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করা হয়। এভাবে তার জীবনকাল দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণে না-গিয়ে (সহজভাবে) থ্যালাসেমিয়াকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। (ক) থ্যালাসেমিয়া বাহক, (খ) থ্যালাসেমিয়া মাইনর এবং (গ) থ্যালাসেমিয়া মেজর। প্রথম দুটিতে অনেকে কোনো পার্থক্য দেখতে চান না, তবে সামান্য পার্থক্যের বিষয় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই দুটোতে বাইরে থেকে কোনো সমস্যা দেখা যায় না, বিশেষ করে রক্ত পরীক্ষা ছাড়া আর পাঁচ জনের সঙ্গে বাহকের অমিল বুঝাই যাবে না। এদের চালচলন, জীবনশৈলী সবকিছুতেই স্বাভাবিক। মাইনরের ক্ষেত্রে কখনও শ্বাসকষ্ট, রক্তাল্পতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। প্রয়োজনে রক্ত সঞ্চারণও করতে হতে পারে, কখনও আবার যকৃতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তখন চিকিৎসকের পরামর্শই শেষ কথা। থ্যালাসেমিয়া মেজর হলে কম বয়সেই ধরা পড়ে এবং বিধিমতো তার চিকিৎসা পরিষেবাও রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারাত্মক আর্থিক সমস্যায় পড়তে পারেন অভিভাবক। থ্যালাসেমিয়া মাইনর হলে কিছু নিয়ম-কানুনে থেকে এবং চিকিৎসা পরিষেবায় সুস্থ থাকা যেতে পারে তবে মেজরের ক্ষেত্রে রোগী এবং সংশ্লিষ্ট অভিভাবকের দুর্দশার সীমা নেই।
থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা কমাতে হলে একটি সহজ উপায় রয়েছে-বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর রক্ত পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া স্ট্যাটাস জেনে নেওয়া। দু’জন বাহক বিয়ে হলেই থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগে আক্রান্ত শিশু জন্ম নিতে পারে যার দুর্দশা দেখা ও চিকিৎসা ব্যয়ভার সামাল দেওয়া অভিভাবক, মা-বাবার পক্ষে খুবই কঠিন এবং মর্মান্তিক। তিন-চার ঘন্টা ধরে হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে রক্ত গ্রহণ করা, মাঝে মাঝে অন্য যন্ত্রণা এসব পাশে বসে দেখার অভিজ্ঞরাই বলতে পারেন কষ্টের পরিমাণ এবং পরিণাম। যদি কোনো রোগীর ‘বোন-ম্যারো’ ট্রান্সপ্লান্ট চিকিৎসা প্রয়োজন হয, তাহলেও প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়। এর ফলাফলও অজানা।
মাসে মাসে রক্ত সঞ্চারণের সঙ্গে নির্দিষ্ট ওষুধ গ্রহণ, একটা ছক বাঁধা যন্ত্রণার আবর্তনে ঘুরপাকের অভ্যেস হলেও মুখশ্রীতে সহ্যের লক্ষণ অবর্তমানই থাকে। রোগটির সমাজেরই নিয়ন্ত্রণে থাকার বিষয়। কিন্তু সচেতনতার অভাবে কোনো না-কোনো ঘরে থ্যালাসেমিয়ার যন্ত্রণা নিয়ে রোগী আছেই। এমনও দেখা গেছে, পর পর দুই সন্তানেরই মেজর, আবার প্রথম সন্তানের না-হয়ে দ্বিতীয় সন্তান হয়েছে থ্যালাসেমিয়া মেজর। এই আধুনিক সমাজেও বিজ্ঞান চেতনায় আমরা অনেক পেছনে রয়েছি, বিয়ের আগে মা-বাবার ঠিকুজি মেলাতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যস্ত থাকেন, কোনো আপত্তি নেই। সঙ্গে থ্যালাসেমিয়া বাহক কি না জানলেই হল, দু’জন বাহকে বিয়ে না-হলেই কোনো সমস্যা থাকবে না। অনেকক্ষেত্রে গভীর যোগাযোগের মাধ্যমেও বিয়ে হয়, হতেই পারে বিয়ের আগে না-হলে পরেও রক্ত পরীক্ষা করে বাহক কি না জানা যেতে পারে।
একজন বাহক হলে ভবিষ্যত সন্তানে শুধু বাহকের সম্ভাবনাই থাকে। কিন্তু দু’জন বাহক চিহ্নিত হলে গর্ভের সন্তান সুস্থ্য কিনা তা না জেনে সন্তান না নেয়াই ভালো। অন্যথায় নিমন্ত্রণ করে মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনা হতে পারে। দু’জন বাহক হলে গর্ভজাত সন্তান না-চেয়ে দত্তক নেওয়া যেতে পারে। বিয়ের পর সন্তানের সৃষ্টি হলেও গর্ভের দশ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষার মাধ্যমে তা নির্ণয় করে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এইভাবে চিন্তা-ভাবনায় সমৃদ্ধ হলে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনা যেতে পারে। যেভাবে অজ্ঞতার কারণে থ্যালাসেমিয়া রোগী বেড়ে চলেছে, এখনই সবাই মিলে এর প্রতিরোধে না-এগোলে সমস্যার পাহাড় গড়ে উঠবে একদিন। সাধারণভাবে দেখে বাহক চেনা যায় না, কোনো জায়গায় পরীক্ষা হলে শতকরা দশজন পাওয়া যাবে বাহক, এতে ভয়ের কিছু নেই। দুজন বাহকে বিয়ে হলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
ষ আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন