রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রেলওয়ের জমি উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দখলদারদের হাত থেকে রেলের জমি পুনরুদ্ধারে পরিচালিত অভিযান যেন ইঁদুর-বেড়াল খেলায় পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে দফায় দফায় অভিযান চালিয়েও জমি উদ্ধার ও রক্ষা করতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ। মূলত সরকারের প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় দখলবাজ ভূমিদস্যুরা রেলের জমি অবৈধভাবে দখলে নিয়ে নানা রকম বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তুলছে। এ কাজে তারা একদিকে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার আশ্রয় নিচ্ছে, অন্যদিকে মামলার আশ্রয় নিয়ে আইনের ফাঁক-ফোকরে সরকারি উদ্ধার অভিযান ব্যর্থ করে দিচ্ছে। এভাবেই সারাদেশে রেলের সাড়ে ৪ হাজার একরের অধিক পরিমাণ ভূমি অবৈধ দখলে থাকছে বছরের পর বছর। গত বৃহস্পতিবার ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, শুধু ঢাকার গে-ারিয়া বস্তি এলাকা থেকে টঙ্গি সেতু পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ছোট-বড় ২৬টি বস্তিতে ৯০০ ঘরবাড়িসহ প্রায় ১২শ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। রেল কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যেই মোবাইল কোর্ট বসিয়ে বস্তিসহ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের আয়োজন করলেও উচ্ছেদের দু-চার দিন পরেই আবার বেদখল হয়ে যায়। সরকার ও সরকারি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া ও যোগসাজশে দখলবাজ-চাঁদাবাজরা এসব বস্তি থেকে ভাড়া বাবদ মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা উঠাচ্ছে। সেসব প্রভাবশালী রাঘব বোয়ালদের এজেন্টরাই মামলা দিয়ে এবং রেলের উচ্ছেদ অভিযানকালে বস্তিবাসীকে উত্তেজিত করে মাঠ গরম করার মাধ্যমে উচ্ছেদ অভিযান ব্যর্থ করে দেয়।
রেলের জমিজমা, অবকাঠামোসহ কোনো স্বার্থই রক্ষা করতে পারছে না রেল বিভাগ। প্রকাশিত এক সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে রেলের ৬১ হাজার ৬০৫ দশমিক ৮৯ একর জমি রয়েছে। রেলের বেহাত হওয়া জমির পরিমাণ কমবেশি সাড়ে ৪ হাজার একর বলে বিভিন্ন সূত্রে বলা হলেও এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য তথ্য সম্ভবত খোদ রেল বিভাগের কাছেও নেই। গতকাল একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, রেলওয়ের মালিকানাধীন জমিজমার একটি পূর্ণ জরিপের পাশাপাশি আগামী ৩০ বছরে এসব জমি ব্যবহারের পরিকল্পনাসহ একটি হালনাগাদ রিপোর্ট প্রদানের লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্পের কাজ ২০০৭ সালে গ্রহণ করা হয়। দুই বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০০৯ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও মেয়াদ পার হওয়ার ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটি শেষ করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। বারবার মেয়াদ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকল্পের খরচ বাড়ানো হলেও চুক্তিবদ্ধ শেলটেক রেলের জমির পূর্ণ ডাটা দিতে পারেনি। নবম বারের মতো সময় বৃদ্ধি করার পর ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শেলটেক রেলওয়ের জমির যে তালিকা দিয়েছে তাতে ১ হাজার ৮৭০ একর জমির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। রেলওয়ে যদি এত বিপুল পরিমাণ জমির কোনো তথ্যই সংরক্ষণ করতে না পারে, তাহলে এসব জমি উদ্ধারের আইনগত প্রক্রিয়াও ব্যর্থ হতে বাধ্য। অন্যদিকে রেলের কথিত জমি উদ্ধারের অভিযানও একপ্রকার তামাশায় পরিণত হয়েছে। প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে রেলের পূর্ব ও পশ্চিম জোনে দেড় শতাধিক বার অভিযান চালিয়ে বেহাত হওয়া হাজার হাজার একর জমির মধ্যে মাত্র ১৮৫ একর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে জমি রক্ষা বা পুনর্দখল বন্ধে কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। উপরন্তু গত এক বছরেই বেহাত হয়েছে ১৮০ একরের বেশি জমি।
দেশের নৌপথের বিলুপ্তি এবং সড়কপথের ওপর অধিক চাপ এবং ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশের বাস্তবতায় পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে রেলপথই সবচেয়ে নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য এবং সারাদেশে বিপুল পরিমাণ জমি ও অবকাঠামোতে সমৃদ্ধ। স্বাধীনতা-উত্তর সাড়ে ৪ দশকে দেশের সড়কপথ সম্প্রসারণ ও সড়ক পরিবহন ও অবকাঠামো উন্নয়নে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ রাখা হলেও রেলপথের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন দূরের কথা, রেলের নিজস্ব সম্পদ রক্ষায়ও কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি কোনো সরকার। রেলের জমিজমা সব সময়ই প্রভাবশালী মহলের দখলবাজির শিকার হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ অভিযানের নামে প্রকারান্তরে দখলবাজদের হাত বদল হয়েছে শুধু। অপরিকল্পিতভাবে নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে প্রতি বছর হাজার হাজার একর কৃষিজমি নষ্ট করা হলেও সড়ক পরিবহন নিরাপদ, সাশ্রয়ী বা পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে ওঠেনি। এহেন বাস্তবতায় রেলের উন্নয়ন এবং আধুনিকায়নের মাধ্যমে সময়ের চাহিদা পূরণের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণই একমাত্র বিকল্প। এ লক্ষ্যে বেদখল হওয়া রেলের জমি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিতে হবে। রেলের আধুনিকায়ন এবং সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি রেল প্রশাসনকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করে রেলওয়েকে একটি লাভজনক খাত হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা প্রয়োজন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন