রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত দুই মাসে ৮০৮টি অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এর মধ্যে খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটে ৩৫৯টি। আর মাদকদ্রব্য, অস্ত্রসহ উদ্ধারজনিত কারণে মামলা হয় ৪১৫টি। তবে নগর পুলিশের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, নগরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’। মাসিক অপরাধ সভায় পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ থাকায় সন্তোষও প্রকাশ করা হয়। গত বছর মহানগরীর ষোলটি থানায় ৪ হাজার ৮৬২টি মামলা হয়েছে। সেই হিসাবে গেল মাসে প্রতিমাসে গড়ে মামলা হয়েছে ৪০৫টি। নতুন বছরের প্রথম দুই মাসে মামলা রেকর্ড হয়েছে ৪০৪টি করে।
গত বছরের প্রথম দুই মাসের তুলনায় খুন-ডাকাতির মতো কিছু অপরাধ কমলেও অন্যান্য অপরাধ আগের মতোই আছে। নগরীর বিভিন্ন স্পটে প্রতিদিনই ছিনতাই ও ঝাপটাবাজির ঘটনা ঘটনা ঘটছে। পথচারী ও ঘরমুখো মানুষের টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র খোয়া যাচ্ছে। বাসা-বাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চুরির ঘটনাও ঘটছে। মোটর সাইকেল, সাইকেল ও রিকশা চুরির ঘটনা বেড়েই চলেছে।
তবে এসব অপরাধের বেশিরভাগ থানা পুলিশ জানে না। কারণ ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করে না। তাছাড়া চুরি কিংবা ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে কেউ মামলা করতে গেলে সহজে পুলিশ মামলা নিতে চায় না। আবার উল্টো হয়রানীর ভয়ে অনেকে এসব ঘটনা পুুলিশকে জানায় না। তবে পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়ে লুণ্ঠিত টাকা-পয়সা বা মালামাল পাওয়া গেছে এমন নজিরও খুব কম।
মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। নানা উপলক্ষে লোকজনকে জিম্মি করে চাঁদাবাজি চলছে। ফুটপাতের হকার থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী কেউ চাঁদাবাজদের কবল থেকে রেহায় পাচ্ছেন না। নীরবেই তারা সন্ত্রাসীদের চাহিদা পূরণ করে চলেছেন। জানা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখা কিংবা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে বিষয়টি চেপে যাচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে সরকারী দলের নামে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে বেশি। পাড়ায়-মহল্লায় বিভিন্ন নামে রাতারাতি গজিয়ে উঠা সরকার সমর্থক কিছু সংগঠনের চাঁদাবাজিতে মানুষ অতিষ্ঠ। পেশাদার অপরাধী, রাজনৈতিক দলের ক্যাডার মাস্তানদের সমান্তরালে বিভিন্ন পরিবহন সংগঠনের নামেও বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে।
মাদক ব্যবসায়ীদের দাপট চলছে মহানগরীর অনেক এলাকায়। প্রকাশ্যে বসছে মাদকের হাট। পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে নিয়মিতই ধরা পড়ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। উদ্ধার হচ্ছে মাদকদ্রব্য। মাদকের ভয়াল বিস্তারের সাথে বাড়ছে আসক্তের সংখ্যা। বাড়ছে অপরাধপ্রবণতাও। নেশার টাকা জোগাড় করতে মাদকসেবিরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পাড়ায়-মহল্লায় চলছে তাদের উৎপাত। পুলিশের হিসাবে বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারী-ফেব্রæয়ারী) মহানগরীতে খুন হয়েছে ১২ জন। অপহরণের শিকার হয়েছেন ৬ জন। দুই মাসে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ১৭টি। জন-নিরাপত্তা বিঘœকারি (দ্রæ. বি.) অপরাধ সংগঠিত হয়েছে ১০টি। বছরের প্রথম দুই মাসে চুরির ঘটনা রেকর্ড হয় ৩৪টি এবং ছিনতাই হয়েছে ১৩টি।
আলোচ্য সময়ে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৪৮টি। এসব অপরাধ ছাড়াও নগরীতে জানুয়ারি মাসে অন্যান্য অপরাধের ঘটনা রেকর্ড হয় ১২০টি এবং ফেব্রæয়ারীতে ১২৫টি। তবে অপরাধের চেয়ে উদ্ধারজনিত কারণে মামলার সংখ্যা বেশি হয়েছে। জানুয়ারী মাসে অস্ত্র আইনে ১২টি ও মাদকদ্রব্য আইনে ২০২টি এবং চোরাচালান আইনে ২টি মামলা রেকর্ড হয়। ফেব্রæয়ারী মাসে অস্ত্র আইনে ৮টি, মাদকদ্রব্য আইনে ১৮৮ এবং চোরাচালান আইনে ৩টি মামলা রেকর্ড হয়। জানুয়ারীতে উদ্ধারজনিত কারণে মোট মামলা হয়েছে ২১৬টি, আর ফেব্রæয়ারীতে হয়েছে ১৯৯টি। সবমিলে মহানগরীর ১৬টি থানায় জানুয়ারী এবং ফেব্রæয়ারী মাসে ৪০৪টি করে দুই মাসে মোট ৮০৮টি মামলা রের্কড হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলাসহ রেঞ্জের এগার জেলায় অপরাধের চিত্র আরও ভয়াবহ। গত দুই মাসে রেঞ্জে ২১টি ডাকাতি ও ১৯টি দস্যুতার ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। খুন হয়েছে ১০২ জন, আর অপহৃত হয়েছে ২১ জন। দুই মাসে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটে ৪টি, পুলিশের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে ১১টি। ছিনতাই হয়েছে ৬৯টি, চুরির ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ১৩৭টি। অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১২৯৯টি। সব মিলে দুইমাসে রেঞ্জে মামলা রেকর্ড হয়েছে ৪ হাজার ২১৩টি।
এদিকে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সম্মেলন কক্ষে পুলিশ কমিশনার মোহাঃ আবদুল জলিল মন্ডলের সভাপতিত্বে ফেব্রæয়ারী মাসের মাসিক অপরাধ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই মাসে নগরীর সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা, অপরাধ সংঘটন ও নিবারণ, মামলা রুজু ও নিষ্পত্তির বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়। সিএমপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পুলিশ কমিশনার তার বক্তব্যে জানান গত মাসে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে নগরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য সকল থানা, ডিবি’সহ সকল ইউনিটকে যৌথভাবে কাজ করার পরামর্শ দেন।
মাদকদ্রব্যের ব্যবহার নির্মূল করার জন্য সকল স্তরের অফিসারকে আন্তরিকতার সাথে কাজ করার নির্দেশনা প্রদান করেন তিনি। উক্ত সভায় গত মাসে ভাল কাজের জন্য ১০০ জন পুলিশ সদস্যকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। সভায় পুলিশ কমিশনার বলেন গত মাসে নগরীর আইন-শৃঙ্খলা যেমন পুুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল তেমনি সারা বছর ধরে নগরবাসীকে একই ধরনের সেবা দিতে নগর পুলিশ বদ্ধপরিকর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন