নোয়াখালী ব্যুরো ঃ মেঘনা বেষ্টিত হাতিয়া উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার ভবরঞ্জন দাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার অনেক শিক্ষক কর্মচারী তার কাছে জিম্মী হয়ে আছে। অভিযোগে প্রকাশ, অর্থের বিনিময়ে বে-সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য, স্কুলের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ, নোট-গাইড বিক্রিসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাতিয়ার ক্যারিংচরের উত্তর-পশ্চিম গাবতলী প্রধান শিক্ষক আব্দুল হান্নানের নাম বাদ দিয়ে ৫ লাখ টাকা নিয়ে ইকবাল হোসেন নামের এক ব্যক্তির নাম দিয়ে তিনি ফাইল চূড়ান্ত করেন। স্কুলটির অন্য ৩ জন শিক্ষককেও বাদ দিয়েছেন এই কর্মকর্তা। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ উঠলে মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব নজহাত ইয়াসমিন এক চিঠিতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠাতে নির্দেশ দেন। কিন্তু এর কোন সুরাহা হয়নি। একই চরের আজিমনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্কুল কমিটির পক্ষ থেকে নিয়োগ পেয়ে পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে এসেছেন স্কুলের দাতা সদস্য নুর নাহার বেগম ও রাশেদ উদ্দিনসহ ৩ জন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দেয়ার পর এই কর্মকর্তা এদের নাম বাদ দিয়ে উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে নতুন শিক্ষকের নাম বসিয়ে ফাইল তৈরি করেন। বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাঈদুল ইসলামের কাছে অভিযোগ গেলে তিনি তদন্ত করে নুর নাহার বেগমের নাম স্থাপন করে ফাইল পুনরায় দেয়ার নির্দেশ দেন এই কর্মকর্তাকে। কিন্তু এর পরেও তিনি তা করেননি।
হাতিয়া উপজেলার অন্তত ৫৫টি বেসরকারি স্কুল জাতীয়করণ করার প্রক্রিয়ায় পূর্বে শিক্ষা অফিসারদের স্বাক্ষর জাল করে শিক্ষকদের নতুন নাম দিয়ে তিনি ফাইল তৈরি করেছেন। এতে নতুন শিক্ষকদের ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা করে আদায় করেন। এসব স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে যারা বিনামূল্যে ক্লাস করে এসেছেন তাদের অধিকাংশকে বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে নিজের ইচ্ছেমতো শিক্ষকের নাম দিয়ে ফাইল তৈরি করেছেন। বঞ্চিত শিক্ষকরা জেলা শিক্ষা অফিসসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন। এদিকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ঘোষণা দেয়ার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদৌস ৩৩টি স্কুলকে জাতীয়করণের আওতায় আনার জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি ডিও (ডিমান্ড অর্ডার) দেন। পরে মন্ত্রণালয় থেকে স্কুলগুলোর বিষয়ে বিশেষ বিবেচনায় কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু উক্ত সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা এমপির ডিও উপেক্ষা করে সেখানে ৩৭টি স্কুলের প্রস্তাব দেন। এই অতিরিক্ত পাঁচটি স্কুল থেকে তিনি অন্তত ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। স্কুলের পিয়ন নিয়োগেও ছিল ভবরঞ্জনের বাণিজ্য। তৎকালীন সংসদ সদস্য প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল আজিমের সময় ৩৬ জন পিয়ন নিয়োগ দেয়া হয়। সে সময় তাকে টাকা না দেয়ায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিনি নিয়োগ ফাইলে স্বাক্ষর করেননি। এপর থেকে সবক’টি নিয়োগে নিয়োগবিধি অমান্য করে দুই থেকে তিন লাখ টাকা নিয়ে নিয়োগ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রার্থীর বাড়ি স্কুল এরিয়ার মধ্যে থাকা বাধ্যতামূলক হলেও তিনি তা মানেননি।
ভবরঞ্জন দাস শিক্ষা অফিসার হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর উপজেলা শিক্ষা অফিসার জগদীশ চন্দ্র দেবনাথ, ফরহাদ আলী, মো. জালাল উদ্দিন, টিপু সুলতানসহ অন্যান্য শিক্ষা অফিসারদের লাঞ্ছিত করেন। পরে মান সম্মানের ভয়ে তারা বাধ্য হয়েই বদলি হয়ে চলে যান। তার অত্যাচারে কেউ এখানে টিকে থাকতে পারেনি। শিক্ষা অফিসাররা বদলি হয়ে গেলে তিনি ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়ে বসে থাকেন। স¤প্রতি এ উপজেলায় নতুন করে শিক্ষা অফিসার যোগদান করলে তিনি তাকে চার্জ বুঝিয়ে দিতেও গড়িমসি করেন। উপজেলা ২৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নয়ন কর্মকাÐের জন্য বরাদ্দের টাকা থেকে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে অর্থ আত্মসাৎ করেন। এসব বিলে শিক্ষা কর্মকর্তা স্বাক্ষর না করলে তাকে লাঞ্ছিত করে স্বাক্ষর আদায় করার অভিযোগও রয়েছে। স্কুলের জন্য বরাদ্দ দেয়া মোবাইল, সিম, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, খেলাধুলার সামগ্রী না দিয়ে সে সব টাকা আত্মসাৎ করেন এই কর্মকর্তা। তাছাড়া গত অর্থ বছরে উপজেলার ৮ জন্য সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার জন্য বরাদ্দ দেয়া টাকা বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দ্বীপের সব প্রধান শিক্ষকদের নামে বরাদ্দ দেয়া সব মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। প্রধান শিক্ষকরা জানান, সিমের বিপরীতে মোবাইল বরাদ্দ দেয়া হলেও তাদেরকে মোবাইল ফোন দেয়া হয়নি। যে কারণে সব নাম্বার বন্ধ রয়েছে। এছাড়া প্রতি বিদ্যালয়ে বেশি শিক্ষার্থী দেখিয়ে বিদ্যালয় প্রতি ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা এবং শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা থেকে ২ হাজার টাকা করে কেটে রেখে দেন এই কর্মকর্তা। টয়লেট মেরামতের ২০ হাজার টাকা থেকে স্কুল প্রতি ১০ হাজার টাকা আদায় করেন এই কর্মকর্তা। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আদেশ অমান্য করে ২০-২৫ হাজার টাকা করে নিয়ে অর্ধশতাধিক শিক্ষকদেরকে ডেপুটেশন দিয়েছেন তিনি।
চিকিৎসার নামে বেতনসহ শিক্ষকদেরকে ছুটি গিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করেন এই কর্মকর্তা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদ্য জাতীয়করণ পাওয়া বিদ্যাগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সিরাজ উদ্দিন ২০১৩ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু তার স্বাক্ষর জাল করে বেতনের টাকা আত্মসাৎ করেন ভবরঞ্জন দাস। মাসে ১০ হাজার টাকার মিনিময়ে মিলতি বালা দাসকে দীর্ঘ ৯ মাস ছুটি দিয়েছেন ভারতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আবার তাকে ক্লাসে হাজিরা দেখিয়ে বেতন উঠিয়ে দেন।
এছাড়া বেতনের অর্ধেক ঘুষ হিসেবে নিয়ে সহকারী শিক্ষক বিলাশ কৃষ্ণ দাস, ঝুমুর রানী দাস এবং প্রধান শিক্ষক নিউটন দাসকে দীর্ঘ ছুটি দিয়েছেন। ২০১৫ সালে দ্বীপের হরণী ইউনিয়নের উত্তর পশ্চিম গাবতলী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব ছিলো না। কিন্তু ঐ বিদ্যালয় থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে একই ইউনিয়নের উত্তর-পশ্চিম গাবতলী অমি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নাম ডাবল ব্যবহার করে ডিআরে অন্তর্ভুক্ত করে রেজাল্ট বের করে দেন এই কর্মকর্তা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নোট-গাইড ও সাজেশান নিষিদ্ধ হলেও এই কর্মকর্তা মেঘদুত নামে একটি কোম্পানীর সঙ্গে ৫ লাখ টাকার চুক্তি করে সব বিদ্যালয়ে কোম্পানীটির নোট-গাইড ও সাজেশান বাধ্যতামূলক করে দেন। এই কোম্পানীর সাজেশন বিক্রি না করলে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কারণ দর্শাও নোটিশ ও বদলিসহ হয়রানি করেন এই সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ভবরঞ্জন দাস জানান, তিনি এসব বিষয়ে কিছু জানেন না। আর কেউ তাকে অভিযোগও করেননি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন